
বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত
দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। অধিকাংশ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও গ্রামেই। ব্যাংকগুলোর মোট শাখার প্রায় অর্ধেক গ্রামে। কিন্তু এর পরও ব্যাংকগুলোর ঋণ কার্যক্রম শহরেই সীমাবদ্ধ। মোট ঋণের মাত্র ১২ শতাংশ পেয়েছেন গ্রামের মানুষ। বাকি ৮৮ শতাংশ ঋণই পেয়েছেন শহরের অধিবাসীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামের মানুষদের ঋণ ফেরত দেওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। গ্রামে খেলাপি ঋণও অনেক কম।
কিন্তু শহরের মানুষদের ঋণ হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বেশি। জাল জালিয়াতির মাধ্যমে অনেকে ঋণ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের যে পাহাড় জমে আছে তার সিংহভাগই শহরের মানুষদের পকেটে। কেন্দ্রীভূত এই ঋণ কার্যক্রম ব্যাংকগুলোর জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। ব্যাংকগুলোর উচিত গ্রামের মানুষদের অর্থায়ন নিশ্চিত করা। এতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৮৬ শতাংশই পেয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে ঢাকায় সর্বোচ্চ ৬৮ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ১৮ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য ছয় বিভাগ অনেকটাই পিছিয়ে। এ ছয় বিভাগে ঋণ বিতরণ হয়েছে সব মিলে মাত্র ১৪ শতাংশ।
ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের ব্যাংকিং কার্যক্রম এখন বড় বড় শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ফলে শহরের গ্রাহকদেরই বেশি ঋণ দিতে আগ্রহী থাকে ব্যাংকগুলো। এটা দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের। এ কারণে ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের স্বার্থে পিছিয়ে পড়া বিভাগ ও শহরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তারা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ঋণ বিতরণ বেশি হওয়ার কারণ এসব জায়গায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশি। সব কিছুই এই দুই বিভাগের মূল শহর ঘিরে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ঢাকা শহর রয়েছে সবার শীর্ষে। আবার ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জেলায় কলকারখানা ও ব্যবসা করলেও ঋণ নিচ্ছেন রাজধানীর ব্যাংকের শাখাগুলো থেকেই। কারণ ঢাকায় সহজে ঋণ পাওয়া যায় এবং সমস্যা হলে সমাধানও সহজে হয়। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণও ঢাকাতেই বেশি কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। তাই ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের জন্য অন্য বিভাগেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণ ছিল সবচেয়ে বেশি ৬৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা।
এক বছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিভাগের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণ ছিল ৬৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। সেই হিসাবে গত বছরে মোট ঋণে ঢাকা বিভাগের অংশগ্রহণ বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ। তবে মোট ঋণে গত বছর ঢাকা বিভাগের অংশগ্রহণ বাড়লেও চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ক্ষেত্রে কমেছে। যদিও খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও রংপুর বিভাগের অংশগ্রহণ সামান্য হলেও বেড়েছে। আর অপরিবর্তিত ছিল ময়মনসিংহ বিভাগের ঋণ বিতরণ পরিস্থিতি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মোট ব্যাংক ঋণের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের অংশ ছিল ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বিভাগের ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ কিছুটা কমে নেমে এসেছে ১৭ দশমিক ৬৩ শতাংশে। একই সময়ে চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বিভাগের ঋণ বিতরণ কমার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, কিছু ব্যবসায়ীর ব্যর্থতার কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেক ব্যাংকই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছে। ফলে এ বিভাগে ঋণের গতি কিছুটা কমেছে।
এই সময়ে মোট ব্যাংক ঋণের খুলনা বিভাগের ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ, যা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগের ব্যাংকগুলোর ঋণ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২১ সালে ছিল ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। একইভাবে বরিশাল বিভাগের ব্যাংক ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ দশমিক ১৮ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। সিলেটের ব্যাংক ঋণ ২০২১ সালে ছিল ১ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা গত বছর কমে হয়েছে ১ দশমিক ২০ শতাংশ। রংপুর বিভাগের ব্যাংক ঋণ ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা এক বছর আগে ছিল ২ দশমিক ৪২ শতাংশ। তবে এক বছর আগেও মোট ব্যাংক ঋণে ময়মনসিংহ জেলার যে অবস্থান ছিল তা-ই রয়ে গেছে, গত বছরও এর অংশ ছিল ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের সব বিভাগে গত বছর ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে, তার ৮৮ দশমিক ২৭ শতাংশই গেছে শহরে। আর ১১ দশমিক ৭৩ শতাংশ গেছে গ্রামে। মাথাপিছু ঋণেও এগিয়ে রয়েছে ঢাকা বিভাগই। গত বছর এই বিভাগে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এর পরেই আছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগে মাথাপিছু ঋণ ৭৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া খুলনায় ৩০ হাজার, রাজশাহীতে ২৬ হাজার, রংপুরে ১৯ হাজার, বরিশালে ১৭ হাজার এবং সিলেট ও ময়মনসিংহে ১৫ হাজার টাকা করে মাথাপিছু ঋণ রয়েছে।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকিং কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে। সরকার গ্রামকে শহরায়ণ ও ঘরে ফেরা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচি সফল করতে হলে গ্রামের পুঁজির জোগান নিশ্চিত করতে হবে। কিছু কিছু ব্যাংক উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সেবা প্রদান করছে। কিন্তু এর পরও অধিকাংশ মানুষ মূল ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। আবার ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়া অনেক জটিল। এজন্য গ্রামের মানুষের পুঁজির অন্যতম উৎস ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থা। অনেক এলাকায়ই এখনো মহাজনরা চড়াসুদে গ্রামের মানুষদের ঋণ দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, একথা ঠিক ব্যাংকগুলোর ঋণ কার্যক্রম শহরে বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ। এর মূল কারণ শিল্পকারখানাগুলো অপরিকল্পিতভাবে এই দুই মহানগরে গড়ে উঠেছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের অধীনে শিল্পগুলোর মালিকানা রয়েছে। অর্থাৎ ঋণ সুবিধাভোগী হাতেগোনা কয়েকটি বড় বড় গোষ্ঠী। এদের কারণে পুরো ব্যাংক ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ব্যাংকগুলোতে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করতে হবে। গ্রামের মানুষের উপযোগী করে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে হবে। সব ঋণের ক্ষেত্রে গৎবাঁধা নিয়মের দোহাই দেওয়া ঠিক হবে না।