
গ্যাস উত্তোলন ক্ষেত্র। ছবি: সংগৃহীত
দেশের ২১টি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ৭ মে সকাল ৮টা থেকে ৮ মে সকাল ৮টা পর্যন্ত ২১২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শুধু বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করা হয়েছে ১১০২ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্ধেকের বেশি গ্যাস এসেছে একটি গ্যাস ক্ষেত্র থেকেই।
শঙ্কার কথা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় ওই গ্যাস ক্ষেত্রটির মজুদ দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে উৎপাদন। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর গ্যাস উত্তোলন করা হয় ১৩৩৪.৯ মিলিয়ন ঘনফুট। পরের বছর ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর উৎপাদন নেমে আসে ১২৪৬.৮ মিলিয়নে। আর ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর উৎপাদন নেমে আসে ১১২৮.৮ মিলিয়নে।
মজুদ বিবেচনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ড বিবিয়ানা। পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, ১৯৯৮ সালে আবিষ্কৃত গ্যাস ফিল্ডটিতে প্রমাণিত, সম্ভাব্য ও সম্ভাবনাময় মিলে ৭০৮৪ বিলিয়ন ঘনফুট (৭.০৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস মজুদ ধারণা করা হয়। বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের মালিকানাধীন ওই ফিল্ডের প্রমাণিত মজুদ ৪৪৪৫ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট) আর সম্ভাব্য মজুদ বিবেচনা করা হয় ৫৭৫৫ বিসিএফ। ফিল্ডটি থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে ৪৯৯১.৬০ বিসিএফ। অবশিষ্ট গ্যাস মজুদ রয়েছে ৭৬৩.৮৩ বিসিএফ।
পেট্রোবাংলার ওই হিসেবের পর ইতোমধ্যে আরও ৪৮৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এতে দৈনিক কমবেশি ১.২০ হারে সর্বমোট প্রায় ৫৮২ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসেবে অবশিষ্ট গ্যাসের মজুদ রয়েছে মাত্র ১৮২ বিসিএফ। দৈনিক ১.১০ গ্যাসে উত্তোলন অব্যাহত থাকলে প্রকৃত মাত্র ১৬৫ দিনের মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খোন্দকার আব্দুস সালেক সুফী বলেছেন, গ্যাস ফিল্ডটিতে উৎপাদন কমে আসবে এটা সবার জানা। শঙ্কার হচ্ছে যে কোনো সময় বড় ধরনের ধস নামতে পারে। শেষ দিকে গ্যাসের চাপ কমে যায়, তখন হঠাৎ করেই বড় ধরনের পতন হয়ে থাকে। অনেক দিন ধরেই কমপ্রেসর লাগিয়ে বাড়তি উৎপাদন করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বিবিয়ানার পাশাপাশি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির উৎপাদনও নিম্নগামী। দেশীয় কোম্পানিটি ৫টি গ্যাস ফিল্ড থেকে গত বছরের এপ্রিলে গ্যাস উত্তোলন করেছিল ৬৩৯ মিলিয়ন, নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে ৬১৪ মিলিয়নে নেমে আসে। গত ৭ মে উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র ৫৮৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
যদিও বিবিয়ানায় মজুদের তুলনায় অনেক বেশি মজুদ রয়েছে ওই দুটি কোম্পানির গ্যাস ক্ষেত্রে। বিবিয়ানার তুলনায় গ্যাসের রিজার্ভ অনেক বেশি তিতাস ও রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডেও। সেখানেও আশানুরূপ উৎপাদন করা হচ্ছে না। ১৯৬০ সালে আবিষ্কার হওয়া রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের অবশিষ্ট মজুদ (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মিলে) রয়েছে (৩১ ডিসেম্বর ২০২০ হিসেব অনুযায়ী) ১.৭৭৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। রশিদপুরে গত ৭ মে গ্যাস পাওয়া গেছে মাত্র ৪৩.৫ মিলিয়ন ঘনফুট।
আশার কথা হেচ্ছে ভোলা আইল্যান্ডে নতুন নতুন গ্যাসের মজুদ পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে হতাশার হচ্ছে উদ্বৃত্ত গ্যাস থাকলেও পাইপ লাইনের অভাবে মূল ভূখণ্ডে আনা যাচ্ছে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উৎপাদনে বড় ধরনের ধস নামলে সামাল দেওয়ার মতো বিকল্প নেই। ঘাটতি মেটাতে আমদানি বাড়ানো হবে সেই সুযোগও নেই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানির জন্য দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে। নতুন করে আরও দুটি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা এখনো যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকে রয়েছে। কার্যাদেশ দেওয়ার পর কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগবে। এছাড়া একটি ল্যান্ড বেজড এলএনজি টার্মিনালের উদ্যোগ রয়েছে, সেই প্রক্রিয়া কাগজে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বাড়তি গ্যাস আমদানির সুযোগ একেবারেই ক্ষীণ।
ততদিন বিবিয়ানা থেকে পাওয়া ১১০০ মিলিয়ন গ্যাস নিরবচ্ছিন্ন পাওয়া নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। এখনই যে সংকট চলমান, উৎপাদন কমে গেলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। সে নিয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তেমন তৎপরতা দৃশ্যমান নয়।
পেট্রোবাংলার বিদায়ী চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বিবিয়ানার রিজার্ভ কমে আসছে, সেটি সামাল দেওয়ার জন্য সেখানে নতুন এলাকায় কূপ খননের কাজ শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সেখানে ভালো পরিমাণে গ্যাস পাওয়া যাবে। এ ছাড়া আমরা ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার চলমান রয়েছে। এতে ৬১৮ মিলিয়ন গ্যাস উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিবিয়ানার রিজার্ভের বিষয়টি মাথায় রেখেই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শঙ্কার কিছু নেই, আমরা অনেক কাজ হাতে নিয়েছি, এতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি আমদানির সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজও এগিয়ে নিচ্ছি। কাতার আরও বেশি পরিমাণে গ্যাস দিতে সম্মত হয়েছে, ওমানের সঙ্গে আলোচনাও ইতিবাচক ধাপে রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম কমে আসবে। দেশীয় গ্যাস ফিল্ডে যেটুকু কমে যাবে আমদানি করে সামাল দেওয়া হবে। গ্যাস সরবরাহে শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ২০২৫ সালে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।
বাংলাদেশে মোট ২৮টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। ২১টি গ্যাস ফিল্ডের ১১৩টি কূপ দিয়ে দৈনিক (৭ মে) ২১২৫ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি গ্যাস ফিল্ড (রূপগঞ্জ, কামতা, ফেনী, ছাতক ও সাঙ্গু) পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ৩টি গ্যাস ফিল্ড (কুতুবদিয়া, ভোলা ও জকিগঞ্জ) বন্ধ রয়েছে গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থা না থাকায়।
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে স্থবিরতার কারণেই আজকের এই সংকট বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ইউএসজিএস তাদের এক সার্ভে রিপোর্টে বলেছে বাংলাদেশে আরও ৩২ টিসিএফ গ্যাস অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বর্তমানে বছরে ১ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে, সে হিসেবে আরও ৩২ বছরের মজুদ রয়েছে। দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম সঠিক গতিতে না হওয়ায় আজকের এই সংকট। অচলাবস্থার কারণেই আজকে চড়াদামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।
তিনি বলেছেন, দেশীয় গ্যাস তুললে যে লাভ তার চেয়ে না তুললে বেশি লাভ। আমদানি করলে কমিশনের বিষয় থাকতে পারে। এটা শুধু আজকে থেকে নয়, ঐতিহাসিকভাবেই অনুসন্ধানে স্থবিরতা বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তন হলে একটা পরিবর্তন আশা করা হয়, কিন্তু সেভাবে পরিবর্তন হয়নি। বরং পুর্বের ধারার সঙ্গে নতুন ধারার আমদানি যুক্ত করা হয়েছে। এ অবস্থা থাকলে ৩০ সালে গ্যাস খাত পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে।
সরকার ২ বছরে ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, ভালো উদ্যোগ। আশা করি আগের ১০৫টি কূপ খনন প্রকল্পের মতো যেন হারিয়ে না যায়। বঙ্গোপসাগরে আমাদের সীমানার ওপারে মিয়ানমার অনেক গ্যাস উত্তোলন করছে। অথচ আমরা গত ১০ বছরে কিছুই করতে পারিনি। এটা খুব বেশি বিলম্বিত হয়েছে। এটা ১০ বছর আগে করা গেলে আজকের এই সংকটের সৃষ্টি হতো না।