বিবিসি বাংলা বিশ্লেষণ
ডিজিটাল ব্যাংকে থাকবে না শাখা, এটিএম ও চেকবই

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৩, ১২:২৩

ডিজিটাল ব্যাংকিং চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের
বর্তমান বিশ্বের তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর উন্নত সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবারে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার প্রস্ততির পথে এগিয়ে যেতে চাইছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। আর এবারে সে পথেই পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল ব্যাংকিং চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটির বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হলো- এ ব্যাংকের কোন শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথ বা সশরীরে লেনদেনের কোন ব্যবস্থা থাকবে না।
প্রচলিত ব্যাংকগুলোতে এখনো টাকা লেনদেন, হিসাব দেখার মতো কিছু সেবা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে করা যায়। কিন্তু নতুন যে ব্যাংক চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাতে সকল কাজ হবে প্রযুক্তি নির্ভর। এমনকি এ ব্যাংকে আমানত গ্রহণ, ঋণ দেয়া থেকে অন্যান্য সকল কাজই করা যাবে।
গত বৃহস্পতিবার এই সংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে এখন ব্যাংক গঠনে আগ্রহীরা প্রস্তাব জমা দিতে পারবেন।
বর্তমানে দেশে প্রচলিত ধারার ব্যাংক রয়েছে মোট ৬১টি। আর এসব অনেক ব্যাংকের রয়েছে অনলাইন সেবাও।
অন্যদিকে নতুন চালু হতে যাওয়া ডিজিটাল ব্যাংক শুধুমাত্র মোবাইল, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করেই করা যাবে।
লেনদেন পদ্ধতি
গ্রাহকরা মোবাইল বা অ্যাপের মাধ্যমে এই ব্যাংকে লেনদেন করতে পারবেন। প্রয়োজন নেই সশরীরে ব্যাংকের কোন শাখায় যাওয়ার।
থাকবে না ব্যাংকের নিজস্ব কোনো শাখা বা উপশাখা, এটিএম, সিডিএম ইত্যাদি। তবে প্রধান একটি কার্যালয় থাকতে পারে।
এমনকি এটিএম কার্ড বা এজেন্ট ব্যাংকিংও থাকবে না। তবে ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড বা অন্য প্রযুক্তিনির্ভর সেবাগুলো যথারীতি থাকবে।
এখানে অ্যাকাউন্ট খুলতে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নিজস্ব তথ্যাদি আপলোড করে একজন সহজেই তার ব্যক্তিগত হিসাব খুলতে পারবেন। অনুরুপ ঋণ নেয়ার জন্যও প্রয়োজনীয় নথিপত্র আপলোড করে ঋণের আবেদন করতে পারবেন।
আর যারা বেতন-ভাতা বা ব্যবসার টাকা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তারাও অনলাইনে নিজের হিসাবে তা নিতে পারবেন।
এছাড়াও অন্য ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবহার করেও টাকা জমার ব্যবস্থা রয়েছে।
ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা চালু হলে গ্রাহক যেকোনো স্থানে বসেই লেনদেন করতে পারার পাশাপাশি অন্যদের অ্যাকাউন্টেও করতে পারবেন লেন-দেন।
এসব ব্যাংক ক্ষুদ্র, বড় বা মাঝারি শিল্পে কোন ঋণ দিতে পারবে না। আর বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনের জন্য ঋণপত্রও খুলতে পারবে না এসব ব্যাংক।
তবে প্রযুক্তিনির্ভর সেবা হওয়ায় এসব ব্যাংকের কোনো কোনো সেবা দিন রাত ২৪ ঘণ্টাই পাওয়া যাবে।
প্রচলিত ইন্টারনেট ব্যাংকিং বনাম ডিজিটাল ব্যাংকিং
এ প্রসঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার খোরশেদ মকসুদ বলেন, প্রচলিত ব্যাংক বেশ সময় নির্ভর। কেননা সেবার জন্য সশরীরে এখানে গ্রাহককে আসতে হয়। ঋণ নেওয়া, আমানত খোলা, স্টেটমেন্ট নেওয়ার জন্য অনেক সময় ব্যাংকে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়।
কিন্তু এসব ব্যাংকে সেসব করতে হবে না। কিন্তু সব ধরনের সেবাই পাওয়া যাবে। লেনদেনের সকল বিষয় হবে ভার্চুয়ালি।
গ্রাহকদের সুবিধা-অসুবিধা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যান্য দেশে যেভাবে ডিজিটাল ব্যাংকিং চালু হয়েছে, বাংলাদেশেও সেটা চালু হলে:
• ব্যাংকে না যাওয়ায় গ্রাহকদের সময় সাশ্রয় হবে।
• ব্যাংকের শাখা না থাকায় ব্যয় কমে যাবে। ফলে ব্যাংকগুলো সাশ্রয়ে কম খরচে গ্রাহকদের সেবা দিতে পারবে।
• বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে গ্রাহক অ্যাকাউন্ট খুলতে এবং ব্যাংকিং সেবা নিতে পারবেন।
• চব্বিশ ঘণ্টার যেকোনো সময় এই ব্যাংকের সেবা নেওয়া যাবে।
তবে একটা জটিলতাও রয়েছে- প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতার অভাব এবং প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক মোবাইল ফোন না থাকায় অনেকেই এ ধরনের ব্যাংকিংয়ের সেবা নিতে চাইলেও তা কঠিন হয়ে পড়বে।
দেখা যায়, ক্ষুদ্র বিক্রেতাদের 'ক্যাশলেস লেনদেনে' উৎসাহিতের চেষ্টা করা হলেও এখনো অনেকেই নগদ লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষ, নগর জীবনের বাইরের মানুষকে এই সেবার আওতায় আনা যাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সাথে যেভাবে মানুষজন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তেমনভাবেই ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার সাথেও কয়েক বছরের মধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
কি আশঙ্কা
বাংলাদেশে যেখানে অনেক সময় প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতিতেও নানা অভিযোগ ওঠে আসে গ্রাহকদের পক্ষ হতে সেখানে আস্থার সংকট মেটাতে এসব ডিজিটাল ব্যাংকের ওপর গ্রাহকরা কতটা আস্থা রাখতে পারবেন?
এর জবাবে মকসুদ বলেন, “এখনো কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর আস্থা রেখে অসংখ্য মানুষ লেনদেন করছে। সেটাও একটা ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা। এক্ষেত্রেও হবে। তবে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে শক্তভাবে নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। “
বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনে বলা হয়েছে, প্রচলিত সব ব্যাংকের মতো এসব ডিজিটাল ব্যাংকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব বিধিবিধান, নির্দেশনা মেনে চলতে হবে এবং নজরদারির মধ্যে থাকবে। তাদেরকেও আমানতের একটা অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হবে।
শাখা না থাকলেও এসব ব্যাংকের একটি প্রধান শাখা থাকবে।
এমনকি গ্রাহকের অভিযোগ বা অসন্তুষ্টির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। গ্রাহক চাইলে প্রধান কার্যালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ দিতে পারবেন।
কেমন চ্যালেঞ্জ রয়েছে
ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা সবার জন্য সমান এবং স্বচ্ছ হবে কি না- তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকে মধ্যেই।
এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখনো প্রান্তিক অনেক মানুষ প্রচলিত ধারার ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসেনি। তাদের এই প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবার অন্তর্ভূক্ত কতটা করা যাবে তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
পাশাপাশি সাইবার সিকিউরিটির বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন ‘’প্রচলিত ব্যাংকের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার কারণেই ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের কথা আসছে। কিন্তু বর্তমানে যে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে- সেখানে বলা হয়েছে এমডিকে হতে হবে ব্যাংকিং সেবায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞ। তাহলে তো সেই প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের চিন্তাভাবনা থেকেই ডিজিটাল ব্যাংকিং চালু করা হচ্ছে। কিন্তু এখানে বরং প্রযুক্তিতে দক্ষ আধুনিক চিন্তাভাবনার লোকজনকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এটা তো একপ্রকার স্টার্ট-আপ।
স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে মানুষের আস্থা আনা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।