Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

তাইওয়ানের আমদানি-রপ্তানিতে ধস

Icon

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৩, ১৩:৪১

তাইওয়ানের আমদানি-রপ্তানিতে ধস

বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতির কারণে টানা নিম্নমুখী তাইওয়ানের রপ্তানি। ছবি:

তাইওয়ান মাত্র ১৩ হাজার ৮২৬ বর্গমাইলের এক দ্বীপ। আয়তনে চীনের চার শতাংশেরও কম। লোকসংখ্যায় দুই শতাংশও নয়। অথচ এ দ্বীপটি ৯০-এর দশক থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান আঞ্চলিক হাব হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও মূল্যস্ফীতির পর বিশ্ব অর্থনীতি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতির কারণে টানা নিম্নমুখী তাইওয়ানের রপ্তানি। বছরপ্রতি ২৩.৪ শতাংশ কমে এখন তা ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ১৪ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি কমেছে। রপ্তানি শিগগিরই বাড়ার কোনো আশাও দেখা যাচ্ছে না।

তাইওয়ানের পরিসংখ্যান বিভাগের মহাপরিচালক বিট্রিস সাইয়ের মতে, ‘টানা দশম মাসের পতনকে চিহ্নিত করা হলো। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রাহকরা মূলত সতর্কতামূলক ইনভেন্টরি পদ্ধতি বজায় রেখেছেন।’ রপ্তানি কমার জন্য বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি এবং প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদহার বাড়ানোকে দায়ী করেছেন তিনি। প্রযুক্তিভিত্তিক গ্যাজেটের চাহিদাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। তাইওয়ান স্মার্টফোন, কম্পিউটার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যাপ্লিকেশনগুলোর জন্য ইলেকট্রনিকসের একটি প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত।

অন্যদিকে প্লাস্টিক, রাসায়নিক, খনিজ ও টেক্সটাইল পণ্যগুলোর রপ্তানি ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। রপ্তানি কমে যাওয়া ছাড়াও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে স্থানীয় সংস্থাগুলো কৃষি ও শিল্পের কাঁচামাল, পাশাপাশি মূলধন সরঞ্জাম কেনা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। ফলে আমদানিও ২৯.৯ শতাংশ কমে ২ হাজার ৬৩৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। জুন মাসের তথ্যে ৫৯৬ কোটি ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছে। তবে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের পরিস্থিতি মে মাসের পূর্বাভাসের চেয়ে খারাপ ছিল। দ্বিতীয় প্রান্তিকে রপ্তানি কমেছে ১৬.৯ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ২৪ শতাংশ।

গত ১১ এপ্রিল তাইওয়ানের অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, এক বছর আগের চেয়ে গত মাসে রপ্তানি কমেছে ১৯.১ শতাংশ। এর আগে ব্লুমবার্গের এক জরিপে জানানো হয়েছিল, তাইওয়ানের রপ্তানি কমতে পারে ১৫.৪ শতাংশ। তাছাড়া ফেব্রুয়ারিতে স্ব-শাসিত অঞ্চলটির রপ্তানি কমে ১৭.১ শতাংশ। মার্চে তাইওয়ানের আমদানি কমেছে ২০.১ শতাংশ, যা পূর্বাভাস ১১.৪ শতাংশ থেকে অনেক বেশি। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত ডিসেম্বরে তাইওয়ানের রপ্তানি আয় এক বছর আগের তুলনায় ১২.১ শতাংশ কমেছে। মোট রপ্তানি আয় ছিল ৩ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলার। নভেম্বরে অঞ্চলটির রপ্তানি ১৩.১ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। 

রপ্তানি কমার কারণ হিসেবে মন্ত্রণালয় বলেছে, জিরো কোভিড নীতি থেকে সরে আসার পর চীনজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক করোনা সংক্রমণ উৎপাদন খাতকে বাধাগ্রস্ত করছে, রেকর্ড মূল্যস্ফীতির চাপ এবং প্রধান অর্থনীতিগুলোয় সুদের হার বাড়ার কারণে বিশ্বজুড়ে চাহিদা ধীর হয়ে পড়েছে। এক বিবৃতিতে তাইওয়ানের অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নতুন প্রযুক্তির হাত ধরে তৈরি হওয়া ইতিবাচক চাহিদাও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রবণতা থামাতে পারছে না। ডিসেম্বরে মোট ইলেকট্রনিকস উপাদানের রপ্তানি ১.৪ শতাংশ কমে ১ হাজার ৬০৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। তবে এ সময়ে সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি ০.৮ শতাংশ বেড়েছে। টিএসএমসির মতো সংস্থাগুলো গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও স্বল্প দামের পণ্যে সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ অব্যাহত রাখায় এ বিভাগে ইতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম চুক্তিভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি অ্যাপল ও অন্যান্য বৈশ্বিক প্রযুক্তি জায়ান্টকে সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ করে থাকে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের কাছে সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ তাইওয়ান। দ্বীপটি তাদেরই অংশ- এ নিয়ে কোনো আপস করতে রাজি নয় চীন। আবার তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারও চীন। গত ডিসেম্বরে দ্বীপটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে ১ হাজার ৪২৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এ রপ্তানির পরিমাণ এক বছর আগের তুলনায় ১৬.৪ শতাংশ কম। এর আগে নভেম্বরেও দেশটিতে তাইওয়ানের রপ্তানি ২০.৯ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। এছাড়া ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ২.৬ শতাংশ কমেছে। এ হার নভেম্বরের ১১.৩ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। এ সময়ে তাইওয়ানের আমদানি ৩ হাজার ৯৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আমদানির পরিমাণ এক বছর আগের তুলনায় ১১.৪ শতাংশ কম। এ হার অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাস ১০.২ শতাংশের চেয়ে বেশি। এর আগে নভেম্বরে দ্বীপটির আমদানি ৮.৬ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল।

গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে তাইওয়ানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। পরিসংখ্যান সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত উপাত্তে দেখা গেছে, গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে তাইওয়ানের জিডিপি ০.৮৬ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। যেখানে একই বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪.০১ শতাংশ। রয়টার্সের জরিপে যেখানে ১.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালের আর্থিক মন্দার সময়ে ১.১৩ শতাংশ সংকোচনের পর ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে রেকর্ড সংকোচনের মধ্য দিয়ে গেছে তাইওয়ানের অর্থনীতি।

চতুর্থ প্রান্তিকে তাইওয়ানের রপ্তানি বছরওয়ারি কমেছে ৮.৬৩ শতাংশ। ইউক্রেন যুদ্ধ ও মহামারি পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং সরবরাহ চেইন সংকটের কারণে উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে ম্যানুফ্যাকচারাররা। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও শিল্প উপকরণের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ভুগছে তাইওয়ান। চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে সংঘাত হলে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও অতিমাত্রায় বিশ্বায়নের ধারক-বাহক সেমিকন্ডাক্টরের ভ্যালু চেইন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে। এই ক্ষুদ্রাকার চিপগুলোই পরবর্তী প্রজন্মের প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য। এই চিপ তৈরি ও সরবরাহ করায় তাইওয়ানের একক আধিপত্য তাদের জন্য এক রক্ষাকবচ; একই সঙ্গে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিও। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতে এখন তৎপর। একই সঙ্গে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের প্রভাব বলয় থেকে তাইওয়ানকে সরিয়ে রাখতে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না।

সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ ধারার মধ্যে প্রধানত রয়েছে ছয়টি অঞ্চল- যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন ও তাইওয়ান। মার্কিন সংস্থাগুলো চিপ ডিজাইনে শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও চিপের উৎপাদনকেন্দ্র মূলত এশিয়ায়। যেমন তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বিশ্বের সর্ববৃহৎ চিপ গঠনপ্রণালি প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান তাইওয়ানের প্রস্তুতকৃত সেমিকন্ডাক্টর চিপের ওপর নির্ভরশীল। তেমনি চীন-তাইওয়ানের পারস্পরিক বাণিজ্যও সেমিকন্ডাক্টরের ওপর নির্ভরশীল। ২০২১ সালে চীন ৪৩০ বিলিয়ন ডলারের অধিক মূল্যমানের সেমিকন্ডাক্টর চিপ ক্রয় করে, যার ৩৬ শতাংশই আসে তাইওয়ান থেকে।

চিপের যে পরিমাণ বৈশ্বিক চাহিদা এখন বিদ্যমান, সে পরিমাণে সরবরাহ বিকল্প স্বল্পমেয়াদে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আগে থেকে চিপের মজুদ করাও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ ইতোমধ্যে অনেক শিল্প খাত যেমন আধুনিক গাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে চিপের অভাব রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে নতুন কোনো সংঘাত এলে তাইওয়ানই শুধু নয়; বৈশ্বিক অর্থনীতি আরেক দফা ধাক্কা খাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫