
আয়কর। প্রতীকী ছবি
বেকারদের কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র হচ্ছে বেসরকারি খাত। তবে এই বেসরকারি চাকরিতে শঙ্কা অনেক। নেই চাকরির নিশ্চয়তা, সুরক্ষা, কিছু প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ড থাকলেও, নেই পেনশন বা অন্যান্য অবসরোত্তর সুবিধা। অবসরকালীন একমাত্র সুবিধা সেই প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর সাড়ে ২৭ শতাংশ কর বসিয়েছে সরকার। চাকরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সরকারিজীবীদের রাখা হয়েছে নতুন এই করের বাইরে। এই বৈষম্যমূলক করনীতির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন কর্মীর অবসরকালীন প্রাপ্য একমাত্র প্রভিডেন্ট ফান্ডে এত উচ্চহারে কর আরোপ উচিত হয়নি। আবার সরকারি চাকরিজীবীদের করের আওতায় বাইরে রাখাটাও সংবিধানসম্মত হয়নি।
বাংলাদেশে নতুন আয়কর আইন গত জুনে জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। ২০২৩ সালের আইনে প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর কর আরোপের এই বিধানটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও বেসরকারি খাতের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি তহবিল ও শ্রমিকদের লভ্যাংশের তহবিলে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক এবং করছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। নতুন আইন অনুসারে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রভিডেন্ট ফান্ডের রিটার্ন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জমা দিতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে প্রভিডেন্ট ফান্ডের আয়ের ওপর সাড়ে ২৭ শতাংশ কর। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য অবশ্য এই আয়কর নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ডের বাইরে সরকারি চাকরিজীবীরা আজীবন পেনশন সুবিধা পান। যেটি বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান আজ পর্যন্ত চালু করেনি। আবার সরকারি চাকরিজীবীদের ভবিষ্য তহবিলে সরকার ১৩ শতাংশ সুদ দেয়। এটা আমানতের ওপর সর্বোচ্চ সুদ। সঞ্চয়পত্রেও এত বেশি হারে সুদ নেই।
ফরেন ইনভেস্টার্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবির বলেন, কর আদায়ের আরও অনেক উপায় আছে। সাধারণত কর্মচারীরা অবসর গ্রহণের পর প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে উপকৃত হন। তাই অবসরকালীন সুবিধার ওপর সরকারের কর আরোপ উচিত নয়। আবার কর আরোপের বিধানে বেসরকারি ও সরকারি খাতের প্রভিডেন্ট ফান্ডকে সমানভাবে বিবেচনা করা হয়নি, যা বৈষম্যমূলক। এটি প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
এনবিআরের তথ্যমতে, দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ কর প্রদান করেন না। তবে সরকারি ও বেসরকারিতে নিয়োজিত কর্মীরা করের আওতায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অভ্যন্তরীণ কর আহরণ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে তাদের ঋণ প্রদান প্রকল্পের জন্য। কর আদায় প্রক্রিয়ার সহজ শিকার বেসরকারি কোম্পানি ও চাকরিজীবীরা। তাদের কাছ থেকে কর আদায়ে শুধু নিয়ম করলেই হয়। কোম্পানিই হিসাব করে কর পৌঁছায় সরকারের কোষাগারে। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের উপার্জন, বিদেশে অর্থপাচার যারা করছেন তাদের বিষয়ে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার। সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয়ের প্রমাণ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা চিহ্নিত । কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। দেশের সরকারি চাকরিজীবী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তির সন্তান, আত্মীয়স্বজন বিদেশে লেখাপড়া করছেন, বাড়িগাড়ি কিনছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন-কিন্তু তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো পদক্ষেপ এনবিআর নিচ্ছে না।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্যে বলেছেন. নতুন নীতির ফলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু রাখতে এবং চালু করতে নিরুৎসাহিত হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে নেবে না আর বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে নেবে, এই সিদ্ধান্ত চরম বৈষম্যমূলক, একটা সভ্য দেশে এটা চিন্তাও করা যায় না। আর এ কর আদায় হবে নিশ্চয়ই পিএফ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। যা চরম অন্যায়।
দেশের সরকারি চাকরিজীবীদের সংখ্যা ১৪ লাখের মতো। বেসরকারি চাকরিজীবীদের সঠিক সংখ্যা জানা নেই। কয়েক কোটি মানুষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত এটি সহজেই অনুমেয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে চাকরি করেন এমন সংখ্যা ১ কোটি বা তার বেশি হতে পারে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শেষে নিজের জমানো ও সমপরিমাণ অফিসের দেওয়া টাকা এবং জমা টাকার ওপর সুদ বাবদ বেসরকারি চাকরিজীবীরা কিছু টাকা পান। সব প্রতিষ্ঠানে ভবিষ্য তহবিলও নেই। আবার শ্রম আইন অনুযায়ী আনুতোষিক দেয় না অনেক প্রতিষ্ঠান। সেটা নিশ্চিতে সরকারের নজর নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন ও পরিচালনা সম্পর্কে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে জানা যায়, এই ফান্ড পরিচালনা করা হয় ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে। কোম্পানির পরিচালক এবং কর্মচারীদের সদস্যদের সমন্বয়ে ৭ থেকে ১১ সদস্যবিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। এটি কোম্পানি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি হিসাব-নিকাশ। কোম্পানির আয়-ব্যয়ে প্রভিডেন্টের হিসাব যুক্ত করা হয় না। বিভিন্ন ব্যাংকের এফডিআর, সঞ্চয়পত্র কেনা, সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করা হয় প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ। নিয়মানুসারে ওইসব বিনিয়োগের মুনাফায় যে কর কর্তনের বিধান আছে সেই কর প্রদান করা হয়। বেসরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ড বিনিয়োগে প্রচলিত সুদ পাওয়া যায়, কিন্তু সরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডের মুনাফা ১৩ শতাংশ। এটি যে কোনো বিনিয়োগের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ সুদহার।
এদিকে একই সুবিধাভোগী একপক্ষের ওপর করারোপ আরেক পক্ষকে করের বাইরে রাখার বিষয়টি সংবিধানের লঙ্ঘন বলে মত দিচ্ছেন অনেকেই। সংবিধানের ১৯(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বেসরকারি খাতের কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা কম। কারণ প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ তহবিল থেকে খুব কমই সামাজিক সুরক্ষা পাওয়া যায়। তাই কর আরোপের ফলে বৈষম্য বাড়বে। বেসরকারি ও সরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডের মধ্যে কর আরোপের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য রাখা ঠিক হবে না। কর আদায় বাড়াতে কর্তৃপক্ষ মরিয়া, যা মূলত ফাঁকিদাতা ও অবৈধ অর্থ পাচারকারীদের ধরতে এনবিআরের অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।