Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষিবান্ধব কতটুকু

Icon

এম ডি হোসাইন

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:০৩

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষিবান্ধব কতটুকু

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় (খামারবাড়ি)। ফাইল ছবি

কৃষির সম্প্রসারণ মানে খামার তৈরি। মূলত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয়কে খামারবাড়ি বলা হয়ে থাকে। সব শ্রেণির চাষিকে চাহিদাভিত্তিক ফলপ্রসূ ও কার্যকর সেবা দেওয়ার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষির টেকসই উন্নয়ন এবং কৃষিভিত্তিক চাহিদা পূরণের জন্য খামারবাড়িতেই বিশেষায়িত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। 

একসময় কৃষক প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল থাকলেও এখন তার মনোযোগ থাকে সঠিক পরামর্শ পাওয়ার বিষয়ে। সেই পরামর্শ সহজ করে তোলার ক্ষেত্রে খামারবাড়ি কিংবা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অস্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ।

১৯০৬ সালে স্বতন্ত্র কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওই সময় কৃষি বিভাগের খামারবাড়ি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১০০০ একর জমি নিয়ে বিস্তৃত খামারটিকে কৃষি বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেওয়া হয়। প্রথমদিকে প্রতিষ্ঠানটিতে কৃষি বিজ্ঞানে জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা ছিলেন না। দেশে কৃষি বিষয়ে বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা নিয়োগসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা সহজ হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী ১৯৭২ সালে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকা-কে জোরদার করার লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ড, তামাক উন্নয়ন বোর্ড, হর্টিকালচার বোর্ড এবং ১৯৭৫ সালে কৃষি পরিদপ্তর (পাট উৎপাদন), কৃষি পরিদপ্তর (সম্প্রসারণ ও ব্যবস্থাপনা ) নামে ফসল ভিত্তিক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানসমূহ সৃষ্টি করা হয়।

আমাদের আজকের বিষয় রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কৃষকের সেবা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠলেও প্রতিষ্ঠানটি ঘিরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ-পদোন্নতিতে দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা, জেলা-উপজেলায় বরাদ্দে কমিশন আদায়, কর্মকর্তাদের মধ্যে দলাদলি, সেবা দিতে টাকা লেনদেনসহ নানা অনিয়মে ডুবছে অধিদপ্তরটি। দুর্নীতিবাজের দাপটে ভেঙে পড়েছে শৃঙ্খলা। অবৈধ কর্মকা-ের মাধ্যমে ওই চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

কৃষিতে সবচেয়ে বড় প্রকল্প 
অনিয়ম ও বিতর্কের মধ্যে রয়েছে দেশের কৃষিতে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স (পার্টনার)’। শুরুর আগেই নিয়ম ভেঙে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কুমিল্লা জেলার উপপরিচালক মিজানুর রহমানকে এখানে প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কাজে তার অভিজ্ঞতা না থাকায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দেয়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্প পরিচালক বা প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর নিয়োগে আট সদস্যের একটি কমিটির মাধ্যমে বাছাই প্রক্রিয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কমিটিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের প্রধান নিয়োগের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ও প্রকিউরমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ এবং প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস পর্যন্ত তার চাকরির মেয়াদ থাকতে হয়। কিন্তু মিজানুর রহমানের চাকরি আছে দেড় বছর। তার ক্রয়-সংক্রান্ত বিধানাবলি ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তেমন প্রশিক্ষণ নেই। প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতাও শূন্য। এ বিষয়ে উপপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, আমি আগে কোনো প্রকল্পে কাজ করিনি, এটা সঠিক। তবে আমার টিমের অনেকেরই বিভিন্ন প্রকল্পে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারাই আমার ভরসার জায়গা। সরকার ভালো মনে করেছে বলেই আমাকে এ পদে নিয়েছে।

সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প 
সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য- ফসল আহরণে অপচয় কমানো, উৎপাদন বৃদ্ধি, আহরণের সময় বাঁচানো এবং মুনাফা নিশ্চিত করা। এ প্রকল্পের আওতায় ভর্তুকিমূল্যে কৃষকদের ১২ ধরনের ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র দেওয়ার কথা। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। সরকার ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল মেয়াদে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে শুরু থেকেই এই প্রকল্পটি নিয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

প্রকল্পটি নিয়ে সম্প্রতি নিবিড় পরিবীক্ষণ করে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তৃতীয় পক্ষ হিসাবে ডেভেলপমেন্ট টেকনিক্যাল কনসালট্যান্টস প্রা. লিমিটেডের (ডিটিসিএল) মাধ্যমে এ মূল্যায়ন করা হয়। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) নির্দেশনা না মানা, কারিগরি কমিটির পরামর্শ উপেক্ষা তথা অমান্য করে বেশি দরে যন্ত্রপাতি কেনা এবং নতুন আসবাবপত্র মেরামত দেখিয়ে অর্থ ব্যয় করা, বাজারদর যাচাই না করে উচ্চদরে কৃষিযন্ত্র কেনা, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ সত্ত্বেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা না করে অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ করা, কৃষকদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং প্রকল্পের বার্ষিক সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করার মতো অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে।

কৃষকের অভিযোগ
আইএমইডির সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৭৪ শতাংশ কৃষক অভিযোগ করেছেন, ভর্তুকি পাওয়ার যোগ্যদের তালিকায় নাম ওঠাতে তারা অসুবিধায় পড়ছেন। প্রায় ৪৩ শতাংশ কৃষক বলেছেন, তারা অর্থ দেওয়ার পরও যন্ত্রপাতি পেতে বেগ পেয়েছেন। প্রায় ৬ শতাংশ কৃষকের দাবি, তারা নিম্নমানের সরঞ্জাম পেয়েছেন। ৩২ জেলার ১ হাজার ৮২৪ কৃষকের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে আইএমইডি। হাওড় ও উপকূলীয় এলাকার ৭০ শতাংশ এবং সমতলে ৫০ শতাংশ ভর্তুকিমূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি গরিব কৃষকদের দেওয়ার কথা। অভিযোগ রয়েছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ভর্তুকির সুবিধায় ভাগ বসাচ্ছেন অসাধু কর্মকর্তা, যন্ত্র সরবরাহকারী কিছু কোম্পানি ও স্থানীয় দালাল। ভর্তুকির যন্ত্রের জন্য ঘুষ, যন্ত্রের দাম বাড়িয়ে কৃষকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায়, ভুয়া উপকারভোগী বানিয়ে পুরো যন্ত্রের টাকা আত্মসাৎ, প্রকৃত কৃষকের বদলে অন্যকে যন্ত্র দেওয়া, মানহীন যন্ত্র সরবরাহ, যন্ত্র বিতরণে প্রভাবশালীদের প্রভাব, নষ্ট হলে কোম্পানিগুলোর বিক্রয়োত্তর সেবা না দেওয়া, এক যন্ত্র কয়েকবার বিক্রি করে একাধিকবার ভর্তুকি নেওয়াসহ রয়েছে নানা অভিযোগ।

নানা অনিয়ম
প্রতিবেদনে কোম্পানিগুলোর অনিয়মের বিষয়ে বলা হয়েছে, ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র দিতে অনেক কৃষকের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্ট্যাম্পে সই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের পর সরবরাহকারী কোম্পানি যন্ত্রটি তাদের শোরুমে ফেরত নিয়ে অন্য কোনো কৃষকের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করেছে। 

সম্প্রতি কৃষি প্রণোদনা সামগ্রী বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ ওঠা বাগাতিপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসান আলীকে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়। পেঁয়াজ চাষের প্রণোদনা বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধনের সময় কৃষকরা সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুলের কাছে অভিযোগ করেন, বরাদ্দকৃত উপকরণ ঠিকমতো না দিয়ে কৃষি কর্মকর্তারা দুর্নীতি করেছেন।

পদোন্নতিতে অনিয়ম নিয়ে তোলপাড় হয় সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে। নিয়মের তোয়াক্কা না করেই পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এতে অনেক যোগ্যরা পদোন্নতি পাননি। এতে দুর্নীতিরও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানিয়েছেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিয়োগ ও পদোন্নতি বিধিমালা এবং অফিস আদেশ উপেক্ষা করে গত ১৬ জানুয়ারি অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়, সিলেট অঞ্চল থেকে দুটি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতির আদেশ জারি করার চিঠি কয়েক ধাপে বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ব্লক পোস্ট অর্থাৎ যারা ঝাড়–দার সুইপার পদে প্রথম যোগদান করেছিল তাদের তথ্য গোপন রাখা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন খান স্বাক্ষরিত এ পদোন্নতির অফিস আদেশে ১১ জনকে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদ হতে উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরেই রয়েছে নানা অভিযোগ। কয়েক মাস আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সহকারী পরিচালক তাইজুল ইসলামের বদলিকে কেন্দ্র করে দুই দিন ধরে উত্তপ্ত ছিল রাজধানীর খামারবাড়ি। ডিজির কক্ষ ও প্রশাসন বিভাগে তালা, বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধসহ কর্মচারীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ঘটে এ বদলিকে কেন্দ্র করে।

এদিকে,পার্টনারের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরিসহ শুরু থেকেই ফোকাল পয়েন্ট অফিসার ছিলেন ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রামের (এনএটিপি) পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন শরীফ। এ বিষয়ে এক অনুষ্ঠানে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, ‘প্রকল্পের শুরু থেকে সাখাওয়াত হোসেন অনেক দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। মেধাবী মানুষটি অনেক কষ্ট করে ডিপিপি বানিয়েছেন। কিন্তু নানা কারণে তাকে প্রকল্প পরিচালক করা যায়নি। আশা করি, তিনি এ প্রকল্পের কার্যক্রমে সব সময় সহায়তা করবেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান কৃষিকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য টেকসই ও নিরাপদ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করবে পার্টনার প্রকল্প। যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে দেশের কৃষিকে বদলে দেবেন বলে আশাবাদী।’

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, খামারবাড়িতে অতীতেও এ রকম দুর্নীতি হয়েছে, তবে সাময়িক বরখাস্ত কিংবা বদলির মাধ্যমে বারবার দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেওয়া হয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫