Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমবে এ বছর

Icon

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:৪১

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমবে এ বছর

প্রতীকী ছবি।

জ্বালানি তেলের মূল্য কমে আসায় চলতি বছরে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমবে। বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে আসবে এ বছর। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাসে এমনটাই বলা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক স্তরে নেমে এলে বিশ্বব্যাপী ১৫২টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার কমাবে। ফলে বড় অর্থনীতির দেশগুলোসহ স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে। গত ৪ জানুয়ারি জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগ, ‘২০২৪ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

প্রতিবেদন অনুসারে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৩ সালে ২.৭ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে ২.৪ শতাংশ হতে পারে। ২০২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতি নিম্নগামী হবে, তবে শ্রমবাজার আশানুরূপ পুনরুদ্ধার হবে না। বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ২০২৩ সালের ৫.৭ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে ৩.৯ শতাংশে নেমে আসতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনেক দেশে পণ্যের দাম বাড়ছে, কোথাও কোথাও ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব কারণে সেসব দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।

লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ গ্রুপের তথ্যানুসারে, গত বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বাণিজ্য চুক্তি (মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন) হয়েছে, যা ২০২২ সালের তুলনায় ১৭ শতাংশ কম। ২০০৮-০৯ সালের পর প্রথমবারের মতো বাণিজ্য চুক্তির মূল্য ১০ শতাংশের বেশি কমেছে। অর্থনীতিবিদরা জানান, ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও উচ্চ সুদহারের কারণে এমনটা ঘটেছে। করোনা মহামারির পর একত্রীকরণ ও অধিগ্রহণ কমেছে। নীতিনির্ধারকরা আরও কঠোর পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। বৈশ্বিক সুদহারের দ্রুত বৃদ্ধি প্রাইভেট ইকুইটি মার্কেটকে স্থবির করছে। যুক্তরাষ্ট্রে এনার্জি খাতে এক্সনমবিল ও শেভরনের দুটি চুক্তির প্রতিটির মূল্য ৫ হাজার কোটি ডলারের বেশি। চলতি বছরের শেষ দিকের এ চুক্তি মোট লেনদেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। চতুর্থ প্রান্তিকে চুক্তির মূল্য তৃতীয় প্রান্তিকের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেড়েছে। গত অক্টোবরে গাজায় শুরু হওয়া ইসরায়েলি আগ্রাসন নতুন চুক্তির পথ বন্ধ করে দিয়েছে।

সুইস আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউবিএসের অল্টারনেটিভ ক্যাপিটাল গ্রুপের গ্লোবাল কো-হেড সিমোনা মায়েলার বলেন, ‘২০২৩ স্পষ্টতই একটি খুব ধীর বছর। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম চুক্তি হয়েছে। ইউরোপে এবার বাণিজ্য চুক্তি ২৮ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে ২৫ শতাংশ কম ও যুক্তরাষ্ট্রে ৬ শতাংশ কম হয়েছে।’ গোল্ডম্যান স্যাকসের গ্লোবাল মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশনের কো-হেড মার্ক সোরেল বলেছেন, ‘চুক্তির পরিবেশ সারা বছর প্রতিকূল ছিল। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা পরিস্থিতিকে জটিল করেছে।’ তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে চুক্তি প্রক্রিয়া বাড়তে পারে।

অর্থনীতিবিদরা জানান, করোনা-পরবর্তী মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রবণতা অনেক দেশে দেখা দিয়েছে। মূল মূল্যস্ফীতি (খাদ্য ও জ্বালানি বাদে) যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং বেশ কয়েকটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশে নভেম্বরে শেষ হওয়া প্রান্তিকে বার্ষিক ২.২ শতাংশ কমেছে। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ এসব দেশের গড় মূল্যস্ফীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি নেমে আসবে। বিশেষজ্ঞরা জানান, মূল্যস্ফীতি কমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতিশীল হয়। ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার কমাতে উৎসাহ পায়। 

মার্কিন ফেড, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ড (বিওই) সবাই ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ইউরো অঞ্চলে চলতি বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি ১.৩ এবং যুক্তরাজ্যে ২.৭ শতাংশে নেমে আসবে। তখন মার্কিন মূল্যস্ফীতি ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি ২.২ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। 

মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের তথ্যমতে, গত বছরের নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ২.৬ শতাংশ। খাদ্য ও জ্বালানি বাদে এটি ছিল ৩.২, যা গত ছয় মাসে বার্ষিক হিসাবে মাত্র ১.৯ শতাংশ। প্রসঙ্গত, ফেড এর আগে পূর্বাভাস করেছে যে ২০২৪ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হবে। তবে ফেডের লক্ষ্যমাত্রার ২ শতাংশের ওপর রয়েছে মূল্যস্ফীতি, যা এখনো একটা চ্যালেঞ্জ। নীতিনির্ধারকরা গত বছর সুদহার স্থির রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। চলতি বছর শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট সুদহার কমানোর পূর্বাভাস রয়েছে। নীতিনির্ধারকরা ফেডের জন্য সুদহার কমানো শুরু করতে কোন সময়টি ‘উপযুক্ত’ তা নিয়ে আলোচনাও করেছেন। তারা নতুন করে সুদহার বাড়াতে অস্বীকার করেছেন। তখন ফেড চেয়ারপারসন জেরোম পাওয়েল বলেছিলেন, ‘ফেডের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, সম্ভবত সুদের সর্বোচ্চ হারে বা কাছাকাছি আছি।’

দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের ইল্ডে সাম্প্রতিক পতন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ আবারও স্বল্পমেয়াদি নীতি সুদহার বাড়াতে পারে। ফেডারেল রিজার্ভের নীতিনির্ধারকদের সর্বশেষ বক্তব্যে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ফেডারেল রিজার্ভ উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় ২০২২ ও ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে আগ্রাসীভাবে তার বেঞ্চমার্ক নীতি সুদহার বাড়িয়েছিল। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সুদহার ৫.২৫ থেকে ৫.৫ শতাংশের মধ্যে স্থিতিশীল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব ডালাসের প্রেসিডেন্ট লরি লোগান জানান, অতি সহজ আর্থিক পরিস্থিতির কারণে মূল্যস্ফীতি আবারও বাড়তে পারে। এটি মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে বর্তমান অগ্রগতিকে নষ্ট করতে পারে। ফেডের অতিরিক্ত নীতি সুদহার বৃদ্ধির জন্য বিকল্প পথ খোলা রাখা উচিত।

অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের সিনিয়র অ্যাডভাইজার ও বিওইর মনিটারি পলিসি কমিটির সাবেক সদস্য মাইকেল সন্ডার্স বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমার একটা কারণ খাদ্য, জ্বালানিসহ বৈশ্বিক পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর মুদ্রানীতি প্রয়োগ। এ ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। যেমনইউরো জোনে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রায় দ্রুত ফিরে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে শ্রমবাজারে তীব্র চাপ রয়েছে, যা ধীরে ধীরে কমছে। বর্তমানের এ উন্নতিগুলো মূল্যস্ফীতি তৈরির বিপরীত দিক। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী পণ্য উৎপাদন এবং পরিবহন ব্যাহত হওয়ার পর চাহিদা বেড়ে মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়েছিল। এরপর ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি কয়েক দশকের মধ্যে শীর্ষে পৌঁছেছিল। ইউরো জোনের মূল্যস্ফীতি মূলত রাশিয়ার গ্যাসের অভাবে ভুগছে। এ ছাড়া কোভিড-সময়ে শ্রম খাত ও উৎপাদন স্থবির হয়ে গিয়েছিল। তাই কোথাও কোথাও শ্রমিকদের আর্থিক ঘাটতি পোষাতে মজুরি বাড়ানো হয়েছে, যা সেবা খাতের মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।’

এ ছাড়া আবাসন খরচও সেবা খাতের মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নভেম্বরে কনজিউমার প্রাইস ইনডেস্ক (পিসিই) এক বছর আগের চেয়ে ৩.১ শতাংশ বেড়েছে। আবাসন খরচ বাদ দিলে এটা ১.৪ শতাংশ বেড়েছে। তবে আবাসন খরচের প্রভাব ইউরোপে অনেক কম হয়েছে। বিএমও ক্যাপিটাল মার্কেটস ইকোনমিকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ডগলাস পোর্টার বলেছেন, ‘বেশিরভাগ প্রধান অর্থনীতির দেশ ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ধীরগতির প্রবৃদ্ধি দেখতে পাবে। তবে সুদহার হ্রাস, তরল জ্বালানি, খাদ্যের দাম ও স্বাভাবিক সরবরাহ চেইন বিশ্বব্যাপী মন্দা ঠেকিয়ে দেবে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫