
বাংলাদেশ ব্যাংক। ফাইল ছবি
দীর্ঘদিন আটকে রাখার পর গত বছরের জুনে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নীতি পরিহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ রাখার নীতি প্রত্যাহারের পর গত ছয় মাসে দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার প্রায় ৩ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। চলতি জানুয়ারিতে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার উঠেছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছিল। যদিও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে দেখা যায়নি। উল্টো বিভিন্ন পণ্যের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণের সুদহার বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষকে নিজের প্রয়োজন মেটাতে আরেক দফায় ক্ষতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। বেশি দামে পণ্য কেনার পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ নিতেও তাদের খরচ বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল বাংলাদেশে সফল হওয়া কঠিন। কারণ এখানে পণ্যের মূল্য বাড়ে সিন্ডিকেটের কারণে। বাজার ব্যবস্থাকে জিম্মি করে রাখা কতিপয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী তাদের খেয়ালখুশিমতো পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেন। এখানে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির অন্তত ৫০ শতাংশ এখনো ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ কারণে উন্নত দেশগুলোর মতো সুদহার বাড়িয়ে এখানে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার পুরোপুরি সিন্ডিকেট-নির্ভর। দু-চারজন ব্যবসায়ী চাইলেই কারসাজির মাধ্যমে এখানে পণ্যের দাম বাড়াতে পারেন। আবার ঘুষ-দুর্নীতির ভয়াবহতার কারণে বাজারে কালো টাকার দৌরাত্ম্যও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ কারণে সুদহার বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকার মতো অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে যখন মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল, তখন তারা তাদের সুদের হার বেঁধে রাখেনি। তারা আরও বিচক্ষণতার সঙ্গে মুদ্রানীতি ব্যবহার করেছে এবং সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যাংক ঋণের সুদহার নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি ছয় মাসের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের গড় সুদহার হিসাব করে ‘স্মার্ট’ সুদহার (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক । প্রতি মাসের শেষে বা প্রথম দিনে স্মার্ট সুদহার কত হবে তা জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক, যা পরবর্তী মাসে বিতরণ করা নতুন ঋণের জন্য প্রযোজ্য হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, স্মার্ট সুদহারের সঙ্গে ব্যাংক সর্বোচ্চ তিন দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে। প্রতিমাসে স্মার্ট সুদহার বাড়ছে। জানুয়ারিতে স্মার্ট সুদহার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এতে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সর্বোচ্চ হার হতে পারবে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এ ছাড়া প্রি-শিপমেন্টে রপ্তানি ঋণ এবং কৃষি ও পল্লী ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে হবে স্মার্ট সুদহারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে, যা হতে পারবে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এর সঙ্গে ১ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ নিতে পারবে এসএমই ঋণের বিপরীতে।
গত বছরের ডিসেম্বরে স্মার্ট সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। এতে এক মাসের ব্যবধানে সুদহার বাড়ল ৪২ বেসিস পয়েন্ট; গত সাত মাসে বৃদ্ধির এ হার সর্বোচ্চ। এর আগে গত নভেম্বরে বেড়েছিল ২৯ বেসিস পয়েন্ট, যা ছিল ওই সময়ের ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। নভেম্বর মাসে স্মার্ট সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। ঋণের সুদহার নির্ধারণে গত জুন মাস থেকে প্রতি মাসের জন্য স্মার্ট সুদহার প্রকাশ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম মাসে তা ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এ হিসাবে গত সাত মাসে স্মার্ট সুদহার বেড়েছে এক দশমিক ০৪ বেসিস পয়েন্ট।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি বড় ব্যাংকের নজিরবিহীন দুর্নীতি মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে দুয়েকটি গ্রুপ। এর মধ্যে ইসলামী ধারার ব্যাংক বেশি। আবার রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমাগত কমার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলার সংকটে পড়ে ব্যাংকগুলো। ডলারের জোগান দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছে অনেক ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। টাকার সংকট মেটাতে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সংকটে থাকা ৮-১০টি ব্যাংক ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদে আমানত নিচ্ছে। অন্য ব্যাংকগুলো টিকে থাকতে আমানতের সুদ হার বাড়িয়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ করেছে। আবার সুদহার বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেও নীতিসুদহার গত বছরে দুবার বাড়িয়েছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ নিতে ব্যাংকগুলোকে আগের চেয়ে বেশি হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে। আমানতের সুদহার বাড়ানোর ফলে স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে ঋণের সুদহারও।
প্রায় দুই বছর ধরে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। ২০২৩ সালের শেষ মাস তথা ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশের সীমা তুলে নেওয়া হয়েছিল। গত ছয় মাসে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে চলতি জানুয়ারিতে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারও বেড়ে প্রায় ১২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
একদিকে সুদহার বেড়েছে। অন্যদিকে ২০২৩ সালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ১০ শতাংশের বেশি কমেছে। আর বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। এ সময় খাদ্যশস্যের দামও কমেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন ব্যয়ও এ সময় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে এর কোনোটিরই ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। পণ্যের দাম না কমে উল্টো গত এক বছরে দেশে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। গত বছরজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাজেহাল ছিল দেশের মানুষ। বছর শুরুর মাস তথা জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর নভেম্বরে এসে তা দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে। মাঝে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। তবে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার সরকার প্রকাশিত এ পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুদহার বাড়ছে। কিন্তু এটি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনৈতিক অন্য সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে হলে সুশাসন ও সংস্কার লাগবে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর সুপারভিশন দরকার। করপোরেট সুশাসন না থাকলে কোনো নীতিতত্ত্বই কাজে আসবে না।