
প্রতীকী ছবি।
জ্বালানি তেলের মূল্য কম-বেশি হলে বিশ্ববাজার সরাসরি প্রভাবিত হয়। কারখানা সচল রাখা থেকে শুরু করে খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ, পরিবহন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই জ্বালানি অনেক ক্ষেত্রে অপরিহার্য। তেলের দাম বাড়লে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবনযাত্রার খরচও বেড়ে যায়।
২০২২ সালে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম সর্বোচ্চ ১৩৯ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল এবং গড়ে তা ছিল প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার। সে তুলনায় ২০২৩ সালে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কম ছিল। গত বছর প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ৯৮ মার্কিন ডলার, যা গড়ে ৮৩ মার্কিন ডলার করে পড়েছে।
তবে এ বছর তেলের দাম আবারও বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি নিউজ সার্ভিস এনার্জি ইন্টেলিজেন্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী এক বছরে তেলের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ১১ লাখ ব্যারেল বৃদ্ধি পাবে। তবে ওপেকভূক্ত দেশগুলোর বাইরে থেকে তেলের যে সরবরাহ পাওয়া যাবে, সেটি দিয়ে এই বাড়তি চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। এমনটা সম্ভব হলে ওপেকের সিদ্ধান্তে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে পারে। এদিকে ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) সতর্ক করেছে, মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা তেলের বাজারে সংকট তৈরি করবে। সমুদ্র পথে বিশ্বে যত তেল পরিবহন করা হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই ওই পথ দিয়ে যায়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিস্ট্যাড এনার্জির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ লিওনের মতে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছর প্রায় ৮০ মার্কিন ডলারে প্রতি ব্যারেল তেল কেনা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বড় কিন্তু হলো ‘মধ্যপ্রাচ্য’। মধ্যপ্রাচ্যে যদি উত্তেজনা চরম মাত্রায় বাড়তে থাকে তাহলে বিশ্ববাজারে নির্ণায়ক হয়ে উঠবে সৌদি আরবের অবস্থান। সৌদি আরব বর্তমানে সবচেয়ে বড় তেল রপ্তানিকারক দেশ, যাদের প্রতিদিন প্রায় ৩২ লাখ ব্যারেল অতিরিক্ত তেল উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
সৌদি আরব প্রতি ব্যারেল তেলের দাম দেড়শ মার্কিন ডলারের উপরে নিয়ে যেতে চাইবে না বলে মনে করেন লিওন। সে ক্ষেত্রে দাম ব্যারেলপ্রতি ৯০ থেকে ৯৫ মার্কিন ডলার পড়তে পারে। তবে সবকিছুই মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা ও কয়েকটি যদি-কিন্তুর ওপর নির্ভরশীল। আবার তেলের দাম কমেও যেতে পারে। যদি অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে কম হয় এবং তেলের চাহিদা কমে যায়, সে ক্ষেত্রে ওপেকের সদস্যরা উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে। তবে সেই সম্ভাবনা অনেক কম। আর এমন অবস্থায় ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেলের দাম ৭০ মার্কির ডলারেও নেমে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক বাজারে গত সপ্তাহে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। ডলারের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে চাহিদা বৃদ্ধির ধীরগতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা জ্বালানিটির দাম কমার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে। ২১ মার্চ প্রতি ব্যারেল কেনাবেচা হচ্ছিল ৮৫ ডলার ৩০ সেন্টে। আগের দিন বাজারে পণ্যটির মূল্য স্থির হয়েছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৫ ডলার ৭৮ সেন্টে। অন্যদিকে মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটে (ডব্লিউটিআই) অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ০.৫৩ শতাংশ কমেছে। প্রতি ব্যারেল কেনাবেচা হয়েছে ৮০ ডলার ৬৪ সেন্টে। আগের সেশনে মূল্য স্থির হয়েছিল ব্যারেলপ্রতি ৮১ ডলার ৭ সেন্টে।
গাজার স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের হাতে বন্দিদের মুক্তি ও অবিলম্বে গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ইতিবাচক রূপ নিলে তেলের বাজারে দাম কমে আসতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনায় জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। কারণ প্রধান অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোর অবস্থান ওই অঞ্চলে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রুটগুলোও ওই অঞ্চলকেন্দ্রিক। গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা শুরুর পর থেকে লোহিত সাগরে পশ্চিমা জাহাজে হামলা চালাচ্ছে ইয়েমেনে ক্ষমতাসীন হুতি বিদ্রোহীরা। এর ফলে সৃষ্ট উত্তেজনা ইতোমধ্যেই এলএনজি আমদানির উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কাতার ও ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার মধ্যে যাতায়াতকারী মালবাহী জাহাজগুলো আগে সাধারণত মিশরের সুয়েজ খাল ব্যবহার করে চলাচল করত। ওই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধির পর এখন জাহাজগুলোকে আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল ঘুরে যেতে হচ্ছে। ফলে সময় এবং খরচ দুটিই বেশি লাগছে।
এদিকে আগামী বছরগুলোয় চীনে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদা ধীর হবে বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি তেল ও গ্যাস করপোরেশন সিএনপিসি। চীন বিশ্বের শীর্ষ জ্বালানি তেল ব্যবহারকারী। চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের গবেষণা ইউনিটের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আগামী বছরগুলোয় পেট্রল-ডিজেলচালিত গাড়ির বাজার অনেকটা দখলে নেবে বিদ্যুৎচালিত বাহন। ফলে এ খাতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদা ব্যাপক মাত্রায় কমতে পারে। দেশটির চাহিদা কমার বিষয়টি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামকে নিম্নমুখী চাপের মুখে ফেলতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা।