Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

ঘুষ দিতে গড়ে তোলেন আলাদা কোম্পানি

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১৩:২৩

ঘুষ দিতে গড়ে তোলেন আলাদা কোম্পানি

ঘুষ দিতে গড়ে তোলেন আলাদা কোম্পানি গড়ে তুলেছেন ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম।

সরকার আসে, সরকার যায়, কিন্তু ঘুষ দিয়ে কাজ পাওয়ার বিষয়টির কোনো পরিবর্তন হয় না। অনেকে এই কাজ পাওয়ার জন্য গড়ে তুলেছেন ঘুষ দেয়ার প্রতিষ্ঠান। এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন ওরিয়ন গ্রুপও।  ওরিয়নের ওবায়দুল করিমের নামে রয়েছে বিপুল পরিমান ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ। জানা গেছে, সরকার পরিবর্তনের পর ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের নিজের প্রতিষ্ঠানে পার্টনার বানিয়েছেন। সাজা থেকে রক্ষা পেতে প্রভাবশালীদের ঘুষ দেওয়া ছাড়াও নানাভাবে পক্ষে রাখার চেষ্টা করেছেন। শুধু ঘুষ দেওয়ার জন্য ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। যে প্রতিষ্ঠান থেকে শুধু ঘুষ দেওয়া হয়। 

জানা গেছে, ১৯৯৬ সাল থেকে সব সরকারের আমলেই ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয়ে টিকে আছেন ওরিয়নের ওবায়দুল করিম। করেছেন অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা ও জালিয়াতি। এসবের মধ্যেও ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মামলা থেকে বাঁচতে পারেননি তিনি। ঘুষ লেনদেন, অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ ১৪টিরও বেশি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিন মামলার বিচার শেষে হয়েছে ৪৮ বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু তাকে সাজা ভোগ করতে হয়নি। সর্বত্র ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কারাদণ্ড ঘোষিত রায়ের নথিও গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

এর মধ্যে গত বছর ৫ মে  হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চের দেওয়া রায়ে ওবায়দুল করিম ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও তার স্ত্রীকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে।

২৭৩ পৃষ্ঠার ওই রায়ে উল্লেখ করা হয়, ওরিয়নের ডিজিটাল পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড অনৈতিকভাবে কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাগিয়ে নিতে ২০০৫ ও ২০০৬ সালের বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও তার স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে। এর মধ্যে ওবায়দুল করিম তার সাউথইস্ট ব্যাংকের ১১১০০০১২৮১৪ অ্যাকাউন্ট নম্বর থেকে ৮১৯১৩৫৪ নম্বর চেকের মাধ্যমে ইকবাল মাহমুদ টুকুকে ৫০ লাখ টাকা দেন। 

এ ছাড়া ২০০৬ সালের ৬ জুন ওবায়দুল করিমের ঘুষ বিতরণের প্রতিষ্ঠান ওয়ান এন্টারটেইনমেন্টের মাধ্যমে ভারতে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের ০২৩৩০২২৬১৩ ও ০৫১৩০৯৫৯২০০১ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ১ কোটি ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৯ টাকা দিয়েছে। এসব টাকার ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৬ টাকায় একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে দেওয়া হয়েছে, ৭৪ লাখ ৮ হাজার ৩০০ টাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩ কাঠার একটি প্লট কিনে দেওয়া হয়। বাকি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৮৩ টাকা স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ওবায়দুল করিম দাবি করেছেন সেই টাকা ওই সময়ে ভারতে অবস্থানরত তার ভাইকে বাড়িভাড়া বাবদ দেওয়া হয়েছে। 

এদিকে ২০০৫ সালে ৬ ডিসেম্বর ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট থেকে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখার পে-অর্ডার নম্বর ০৩৯২৯৫৯ মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এই পে-অর্ডারে রিসিভার হিসেবে ওবায়দুল করিমের জামাই মেহেদী হাসানের নাম থাকলেও পরে তার নাম কেটে দিয়ে সেখানে রুমানা মাহমুদ লেখা হয় এবং পার্টিকুলার রিসিভার হিসেবে ওই টাকা রুমানা মাহমুদ উঠিয়ে নেন। এর আগে একই বছর ২৮ মার্চ রুমানা মাহমুদকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে আরও ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়।  এভাবে বিভিন্ন সময়ে ওবায়দুল করিম অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে রায়ের বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে। পুরো রায়টি লেখেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার। রায়ে সমর্থন জানান বিচারপতি খিজির হায়াত। 

এদিকে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কাজ পেতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে গাড়ি ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৫ জুন ধানমন্ডি থানায় মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় ওবায়দুল করিমসহ ৫ জনকে আসামি করা হয়েছিল। তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়। বিচারিক আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তবে ওবায়দুল করিম এ মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করলে শুনানি শেষে অব্যাহতি পান। 

অপরদিকে ঘুষ লেনদেন, অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ ১৪টিরও বেশি মামলা ও ৩ মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে ওবায়দুল করিম ২০০৯ সালে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোট সরকার গঠন করলে সব অপকর্মের দায় থেকে বাঁচতে ওবং ওই সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপিসহ ক্ষমতাধর নেতাদের বাগে আনতে তার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পার্টনার করে নেন। 

এর মধ্যে ওরিয়নের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেন সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমকে। ডাচ্‌-বাংলা পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক এমপি  আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে। ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের পরিচালক পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও নারায়ণগঞ্জের এমপি শামীম ওসমানকে। এমন অনেক মন্ত্রী-এমপিকে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টনার বানিয়ে গত ১৬ বছরে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। এখনো সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫