Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

বড় ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা

Icon

লোকমান তাজ

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২০, ১৯:৩৪

বড় ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। সেই ঈদকে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে নতুন পোশাকের বিকল্প নেই। এই উৎসব ঘিরে নতুন জামা, জুতা ও প্রসাধনী দ্রব্য কেনার হিড়িক পড়ে যায়। নানা আয়ের মানুষ সাধ্য অনুযায়ী এই ঈদে কেনাকাটা করে থাকেন। এই উৎসব ঘিরে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এই সুযোগ নেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

ক্রেতারাও এ সময় পোশাক কেনকাটায় খোঁজে একটু ভিন্নতা। নিজেকে কিছুটা হলেও আলাদাভাবে সাজানোর প্রবণতা থাকে সবার মাঝেই। পিছিয়ে থাকে না শিশুরাও। ঈদ আনন্দের পূর্ণতা আনতে বাবা-মায়ের সঙ্গে কেনাকাটা করেন তারাও।

তবে এ বছর সেই চিত্র নেই। দশ রোজা চলে গেলো। রাজধানীর কোন জায়গার ফুটপাতে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেনি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। বসার কথাও না। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে চলমান ছুটির কারণে গত প্রায় দেড় মাস যাবত বন্ধ রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া আর সব ধরণের দোকানপাট। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সব ধরণের পোশাকের দোকান।

এবার রোজা ও ঈদের আগে সারাদেশে সব ধরণের পোশাকের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় দেশীয় ফ্যাশন হাউজ এবং তৈরি পোশাক বিক্রি করা দোকানগুলো বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। দেশের সব ধরণের শপিং মল, বাজার এবং দোকানপাট বন্ধ থাকায় কিছু ফ্যাশন হাউজ এবং দোকান ক্রেতাদের কাছে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা শুরু করেছে। তবে তার পরিধি চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত কম। তাছাড়া অনলাইনে পণ্য ক্রয়ের বিষয়ে এখনো দেশের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ছয় দফা বাড়িয়ে ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয় ১৬ মে পর্যন্ত। আর এই সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব ধরণের দোকান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

পোশাকের দোকান বন্ধ থাকার ফলে এবার পহেলা বৈশাখে পণ্য বিক্রি করতে পারেনি ফ্যাশন হাউজগুলো, যার ফলে ওই দফায় বড় অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। এবার রোজার ঈদের আগ দিয়ে সেসব ফ্যাশন হাউজ এবং পোশাকের দোকানগুলোর কার্যক্রম শুরু না হলে দেশীয় পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত লাখ লাখ মানুষের জীবন তো বটেই, পুরো ব্যবসা হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকার সাইন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে প্রিয়াঙ্গণ শপিং কমপ্লেক্সে একটি পোশাকের দোকান রয়েছে জয়নাল বেগের। দোকানে মূলত নারীদের পোশাকই বিক্রি করে থাকেন। তিনি বলেন, বছরের দশ-এগারো মাস ব্যবসায় ক্ষতি হলেও রমজান মাসে সারাবছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে তাদের কাছে, যেটি এই বছর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এই ক্ষতির রেশ আগামী অন্তত এক বছর ধরে তাকে টানতে হবে।

বৈশাখ এবং ঈদকে মাথায় রেখে অধিকাংশ দোকান পাঁচ ছয় মাস আগে থেকেই বিভিন্ন পণ্য কিনে এবং অর্ডার দেয়। এসব পণ্য কেনার ক্ষেত্রে দোকানদাররা সাধারণত ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন মেয়াদে ঋণ করে, তারপর ক্রেতাদের আংশিক মূল্য পরিশোধ করে পণ্য কেনে এবং উৎসবের সময় তা বিক্রি করে পরে ঋণ এবং মূল্য পরিশোধ করে থাকে।

কিন্তু ঈদের সময় যেই পরিমাণ বিক্রি হওয়ার কথা, এবছর তা হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসা না হলে দোকানদাররা অর্থ পরিশোধও করতে পারবেন না, যার প্রভাব পড়বে ঈদ পরবর্তী ব্যবসায়িক কার্যক্রমে। অনেক দোকানদারই ঈদের জন্য তৈরি করা পণ্য- যেমন চামড়াজাত পণ্য। নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে পরে বিক্রি করতে পারবে না। আবার অনেক পোশাকও ঈদের পরে বিক্রি হবে না।

দোকানদারদের অনেকে তাদের পুরনো ঋণ শোধ না করে নতুন ঋণ নিতে সমস্যায় পড়বে। ফলে ঈদের পরে নতুন করে কার্যক্রম চালাতে পারবে না তারা। এর প্রভাবে ছোট আকারের অনেক দোকানদারই দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে না বলে আশঙ্কা থেকে যাবে।

আবার দোকানদাররা যেখান থেকে কাঁচামাল কেনে, সেসব প্রতিষ্ঠানের মূল্য পরিশোধ করতে না পারার কারণে দীর্ঘমেয়াদে সেসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোর ব্যবসায় টিকে থাকতে সমস্যা হবে। দোকানপাট বন্ধ থাকায় তৈরি পোশাক বিক্রি করা দোকান মালিকদের পাশাপাশি বিপদে পড়েছেন ফ্যাশন শিল্প খাতের বড়-ছোট উদ্যোক্তারাও।

দেশি উদ্যোক্তাদের সবাই গত প্রায় দেড় মাস ধরে তাদের বিক্রয় কেন্দ্র বন্ধ রাখায় এই উদ্যোক্তাদের সাথে কাজ করা ক্ষুদ্রশিল্প, কুটির শিল্প ও দেশজ বুননশিল্পের সাথে জড়িত লক্ষাধিক শ্রমিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

দেশের ফ্যাশনশিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফ্যাশন অন্ট্রাপ্রনার্স অব বাংলাদেশের সভাপতি শাহীন আহমেদের দেয়া তথ্য মতে, আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া শ্রমিকদের এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখের কাছাকাছি।

শাহীন আহমেদ আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ফ্যাশন হাউজগুলোর সাথে কাজ করা শ্রমিকদের অনেকেই এই খাত থেকে সরে গিয়ে অন্য খাতে কাজ করতে বাধ্য হতে পারেন। বড় ফ্যাশন হাউজগুলো যখন তাদের জন্য পণ্য তৈরি করা তাঁতী বা শ্রমিককে পুরো মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না, তখন তাদের কাজও থমকে যাবে। কারণ অধিকাংশ সময় তারাও মাঝারি বা ক্ষুদ্র পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ নিয়ে বড় হাউজগুলোর জন্য পণ্য তৈরি করে।

সেই শ্রমিকরা যখন তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না, তাদের অনেকেই অন্য খাতে কাজ করে ঋণ শোধ করতে চাইবে। ফলে তারা কাজ পরিবর্তন করে অন্য খাতে শ্রম দেবে, যা পণ্যের গুণগত মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তবে শাহীন আহমেদ জানান, এই নেতিবাচক প্রভাব যেন দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী না হয়, তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সাথে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার ফ্যাশন হাউজ তাদের সংগঠনের সাথে যুক্ত রয়েছেন। এ বছর রোজার ঈদে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা মূল্যের পণ্য বিক্রি হবে বলে ধারণা ছিলো তাদের। ঈদের এই অনুমিত বিক্রির প্রায় পুরোটাই ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করছে উদ্যোক্তাদের সংস্থাটি।

এদিকে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ার কারণে অনেক দোকানই অনলাইনে পণ্য প্রদর্শন এবং বিক্রির উপর জোর দিয়েছে। পোশাক শিল্প খাতের এমন অনেক উদ্যোক্তাই আছেন যাদের কোনো নির্দিষ্ট দোকান বা কারখানা না থাকলেও অনলাইনে বা ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য প্রদর্শন করে বিক্রি করে থাকেন। তবে এই সাধারণ ছুটির সময় অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায়ীরাও কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

আবার লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকায় ঈদের আগে পণ্য বিক্রির লক্ষ্যে কিছু কিছু দোকানের মালিক তড়িঘড়ি করে ফেসবুকে পেইজ খুলে বিক্রির চেষ্টাও করছেন। তবে অনলাইনে পণ্য বিক্রির অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে তারাও খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না। দোকানের পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে ফেসবুক পেইজ খুললেও ক্রেতাদের সাড়া না পেয়ে হতাশ অনেক ব্যবসায়ী।

তবে অনলাইনে বিক্রিতে গত বছরের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো। ঈদ সামনে থাকায় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোতে অনলাইনে অর্ডার পাওয়ার হার বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের ঈদের সাথে তুলনা করলে এবছরের ঈদে অনলাইনে অর্ডারের হার তাদের অনেক বেশি বলে জানা গেছে।

তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য আশার বাণি শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সোমবার (৪ মে) সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রংপুর বিভাগের আটটি জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে ক্ষুদ্র শিল্প, হাটবাজার চালু করাসহ ঈদের আগে কেনাকাটা করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

আগামী ৭ মে থেকে সীমিত আকারে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দোকান-মার্কেট খোলা রাখার অনুমতি দিয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রমজান এবং ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে সীমিত পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্য চালু রাখার স্বার্থে দোকানা-পাট খোলা রাখা যাবে। তবে এই ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ক্রয়-বিক্রয়কালে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করতে হবে।

বড় শপিংমলগুলোর প্রবেশ মুখে হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। দোকান-পাট ও শপিংমলগুলো অবশ্যই বিকেল ৫টার মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশনা রয়েছে এতে। শেষ দিকে এসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে খোলা হলেও ক্ষতির পরিমাণ কতটা কমিয়ে আনতে পারবে তাই এখন ভাবতে হবে ব্যবসায়ীদের।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫