Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

ভারতের নিষেধাজ্ঞায় আটকে যাচ্ছে রপ্তানি পণ্য

Icon

আল আমিন

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ১৭:০২

ভারতের নিষেধাজ্ঞায় আটকে যাচ্ছে রপ্তানি পণ্য

নিষেধাজ্ঞার ফলে আটকেপড়া পণ্যবাহী ট্রাক

ভারত স্থলপথে সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা বিপাকে পড়েছেন।

লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরে প্রাণ গ্রুপের ১৭টি ট্রাক পণ্য আটকে আছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে সাত ধরনের পণ্য রপ্তানি বন্ধের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসহ সাতটি পণ্য কেবল দুটি সমুদ্র বন্দর দিয়ে রপ্তানি করা যাবে।

কিন্তু পোশাক ছাড়া ভারতে চাহিদা বেশি এমন বাংলাদেশি পণ্যের বড় অংশই যায় উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যে। সেখানে সমুদ্রপথে কলকাতায় পণ্য পাঠিয়ে এক হাজার কিলোমিটার বা তার বেশি পথ অতিক্রম করতে হবে।

এতে খরচ কতটা বহন করা সম্ভব, তা প্রশ্নের মুখে।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি বছরে দেড় বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। প্রধান কারণ হলো তৈরি পোশাক শিল্প। তবে ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, আসামসহ ভারতের উত্তর-পূর্ব সাত রাজ্যে বিস্কুট, কেক, চিপস, ফলের পানীয় খুব জনপ্রিয়। আসবাবপত্র রপ্তানিও রয়েছে।

বিশ্বব্যাংক এর ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের পোশাকের ৯০ শতাংশই ভারতে যেত স্থলপথ দিয়ে। আর প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশিরভাগই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে যেত।

“যেহেতু তাদের কলকাতা দিয়ে রপ্তানি করতে হবে, তাই সময় ও খরচ বাড়বে। ফলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারানোর কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সুতরাং এ নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতে আমাদের রপ্তানি কমে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”

ভারতের নিষেধাজ্ঞায় আখাউড়া স্থলবন্দরে রপ্তানি কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। 

ভারতের সিদ্ধান্ত কী?

রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে শনিবার বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য পরিদপ্তর।

এই পণ্যগুলো ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্যের ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন ও ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট দিয়ে ভারতে আমদানি করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের চেংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ি দিয়েও আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

তবে কলকাতা ও মুম্বাইয়ের নাভা শেভা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

প্রাণ গ্রুপ দুশ্চিন্তায়

বাংলাদেশের এই শিল্প গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, এত দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, মৌলভীবাজারের চাতলাপুর, সিলেটের শেওলা ও তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, মেঘালয়ে ফলের ড্রিংকস, কার্বোনেটেড ড্রিংকস, বিস্কুট, কেক, চিপস, স্ন্যাকস রপ্তানি হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল যেমন শিলিগুড়ি ও কুচবিহারের মতো এলাকায় লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে।

প্রাণের কারখানা থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওই পাড়ে আমদানিকারকের গুদামে পৌঁছাতে এক দিনের মতো সময় লাগে। তবে কোনো পণ্যের চালান যদি পরীক্ষা করতে হয়, তাহলে পাঁচ থেকে ছয় দিন লাগে।

নতুন ব্যবস্থায় পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে স্থলপথে পাঠাতে হলে সাতক্ষীরার ভোমরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরই ভরসা। কিন্তু তখন পরে কলকাতা থেকে সড়ক বা রেলপথে প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ওই পণ্য যেতে হবে ত্রিপুরায়।

সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর বা মোংলা বন্দর থেকে কলকাতার হলদিয়া বন্দরে পাঠাতে হবে। তারপর সেখান থেকে সেভেন সিস্টার্সে নিয়ে যেতে হবে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, “কলকাতা হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পাঠাতে কমপক্ষে ১০ দিন সময় লাগবে। এতে আগরতলার আমদানিকারকেরা এত ঘোরা পথে পণ্য নেবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।”

খরচ ও প্রতিযোগিতায় প্রভাব

সীমান্তের ওপারে পণ্য পৌঁছানোর পর সব খরচ আমদানিকারকের। ফলে ওই আমদানিকারকেরা এত পরিবহন খরচ দিয়ে কতটা প্রতিযোগী সক্ষম থাকতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা আছে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের তথ্য বলছে, বছরে গ্রুপটি কেবল ভারতে পাঁচ কোটি ডলারের ফলের ড্রিংকস, কার্বোনেটেড ড্রিংকস, বিস্কুট, কেক, চিপস, স্ন্যাকস রপ্তানি করে থাকে।

এর প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ রপ্তানি হয় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে। এখন পুরো বাজারটি ঝুঁকির মধ্যে পড়ল।

ভারতে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের বছরে আয় ১৫ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মো. হুমায়ুন কবীর।

তিনি বলেন, “ভারতের বাজার আমাদের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। স্থলপথে পণ্য পাঠানো সহজ এবং খরচও কম। এখন এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ছে।”

আসবাব রপ্তানিকারকরাও দুশ্চিন্তায়

বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান এবং হাতিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান বলেন, “বাংলাদেশ থেকে বেশকিছু ফার্নিচার ইন্ডিয়াতে বিশেষ করে উত্তরপূর্ব ভারতে স্থল পথে রপ্তানি হতো। কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞার ফলে ফার্নিচার ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে।”

সরকার কে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “দুই দেশের মধ্যে আলোচনা করে সমাধানের পথ খোঁজা উচিত।”

তৈরি পোশাকের কী হবে

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির মোট পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ছিল ৭০ কোটি ডলার। এর ৯৩ শতাংশই স্থলবন্দর দিয়ে যায়।

নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর সভাপতি মো হাতেম বলেন, “তৈরি পোশাক স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি না হয়ে নৌ পথে হবে, এতে পোশাক খাত খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।”

তবে বিষয়টি এত সরলও না। এর কারণ হলো, ভারতের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলোতে চাপ পড়বে। ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার পর এমনিতেই বন্দরগুলোতে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। তার ওপর ভারতে সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করলে সেই চাপ আরও বাড়বে।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “ভারতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

সুতা নিয়ে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের পাল্টা প্রতিক্রিয়া?

১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জানায়।

জাহিদ হোসেন বলেন, “ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশ সমুদ্র ও স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো ভারত।”

একই মত দিয়েছেন বিকেএমইএর সভাপতি মো. হাতেম। তিনি বলেন, “এটা তো মূলত চলছে রেষারেষি, এই রেষারেষিটার মধ্যে আমাদের যাওয়াটা ঠিক হয় নাই।

ভারতের সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে সতর্ক করে জাহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশকে প্রথমে জানতে হবে কেন এটি আরোপ করা হয়েছে। তারপর দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে।”

সরকারে তাড়াহুড়ো নয়

ভারতে রপ্তানি এরই মধ্যে বিঘ্নিত হলেও বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন রবিবার সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন, তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি।

“আমরা জেনেছি তারা স্থলবন্দর বিশেষ করে আখাউড়া, ডাউকি বন্দরসহ কিছু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

“আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানার পর ব্যবস্থা নিতে পারব। যদি সমস্যা দেখা দেয় বা তৈরি হয় তাহলে উভয়পক্ষ আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করব।”

কোন কোন পণ্যে নিষেধাজ্ঞা

নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা পণ্যগুলো হলো:

• তৈরি পোশাক

• বেকারি পণ্য

• চিপস ও কনফেকশনারির মতো প্রক্রিয়াজাত খাদ্য

• ফল ও ফলফ্লেভারড বা কার্বনেটেড পানীয়

• সুতির বস্ত্র ও সুতির তৈরিজাত বর্জ্য

• প্লাস্টিক ও পিভিসি ফিনিশড পণ্য

• শিল্পে ব্যবহৃত ডাই, প্লাস্টিসাইজার ও গ্রানুলস

তবে বাংলাদেশ থেকে মাছ, এলপিজি, ভোজ্যতেল ও চূর্ণী পাথর প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫