
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমদ
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের কাঠামো অনুসরণ করেই অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট দিয়েছে বলে যে সমালোচনা হচ্ছে, বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এসে তার জবাব দিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
এই সমালোচনা মেনে নিয়েই তিনি বলেছেন, চট করে বিপ্লবী কোনো বাজেট দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রস্তাবিত বাজেটকে জনবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব বলেও দাবি করেন তিনি।
জাতীয় সংসদ বহাল না থাকায় সোমবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন বিটিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে। তবে বাজেট পেশের পরে সংবাদ সম্মেলনের রীতি অক্ষুণ্ন রাখেন তিনি।
মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা ছাড়াও আসেন উপদেষ্টা পরিষদের জ্যেষ্ঠ সদস্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআরের চেয়ারম্যান।
সোমবার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাজেট কমিয়েছেন তিনি। উন্নয়ন বাজেট ছেঁটে ফেলেছেন আগের বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের সমিতি বিজিএমইএ ছাড়া ইতিবাচক বক্তব্য এসেছে কমই। বিএনপি, জামায়াত এমনকি এনসিপির মতো দলগুলোও কড়া সমালোচনা করছে।
অর্থনীতির গবেষকরাও বাজেটের সমালোচনা করছে। তারা বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত সরকারের কাঠামো অনুসারেই বাজেট করেছে। এখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের কোনো দিক নির্দেশনা নেই বলেও সমালোচনা উঠেছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “অনেকে বলেছেন আমরা আগের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি। আসলে আমরা এসব অনুসরণ না করে চট করে বিপ্লবী একটা বাজেট দিয়ে দেব, দারুণ একটা রেভিনিউ আনব সেটা সম্ভব নয়।
“আমরা কতগুলো ফ্রেমওয়ার্ক বা পদাঙ্ক অনুসরণ করে সামনে যাচ্ছি ঠিক। এবার যে ইনোভেশন নেই সেটা কিন্তু নয়। কিছু পদক্ষেপও আছে। বাজেট তিন বছর হওয়ায় বাজেট চলমান থাকায় ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।”
“আমি প্রাথমিকভাবে মনে করি জনবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব বাজেট হয়েছে”, বলেন সালেহউদ্দিন।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টারা ছাড়াও অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও এনবিআর চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, “মোট কথা আমরা সবার সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বাজেট দিয়েছি, যা বিশ্বের অন্য দেশের কাছে যেন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।”
‘সমবেদনা চাই’
দেশবাসী ও সমালোচকদের কাছে সমবেদনাও চেয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “এত চ্যালেঞ্জের মধ্যে আমাদের প্রতি একটু সমবেদনা নিয়ে কাজ করেন, একবারেই একপেশে, কিছুই হয়নি- (এমন না)।”
বাইরের প্রতিটা দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে বলেও দাবি করেন সালেহউদ্দিন। তিনি বলেন, “প্রত্যেকের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে, সেটা আরও একটু সুসংহত করতে দেশের ভেতরের মানুষের যেন একটু ইতিবাচক মনোভাব দেখায়।
“যদি আমরা নিজেরাই বলি খারাপ, তাহলে অন্যরা তো করবেই। কাজেই দেশের ভেতরের মানুষের যদি দেশের প্রতি ভালোবাসা ও সরকারের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব থাকে আমরা সেই প্রত্যাশাই করছি।”
‘সম্পদ সীমিত, চাহিদা অনেক বেশি’
অর্থ উপদেষ্টা সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথাটিও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আপনারা জানেন যে আমাদের সম্পদ সীমিত, চাহিদা অনেক বেশি। বাইরে থেকে সম্পদ আনা, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, পুঁজিবাদের অবস্থা, ব্যাংকের অবস্থা, আইনশৃঙ্খলা অবস্থা সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খলা। এর ভেতরেই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।”
‘কথার ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে’ বাজেট করেননি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমাদের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল। যেমন- মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকখাত, জ্বালানিখাত, রাজস্ব আদায়। এসব কিছুর মধ্যেই বাজেট করতে হয়েছে। তারপরও আমাদের প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার বাড়েনি।”
এতদিন কেবল ‘প্রবৃদ্ধি প্রবৃদ্ধি’ ন্যারেটিভ শোনানোর কথা তুলে ধরে সালেহউদ্দিন বলেন, “গ্রোথ হয়েছে অনেক বেশি, কিন্তু সেটার সুবিধা কে পেয়েছে? সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হয়, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে চালিয়ে যেতে পারে সেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাজেট সাজিয়েছি।”
সুরঙ্গ হাইওয়ে থেকে প্রশস্ত হাইওয়েতে
ক্রান্তিলগ্নে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে একটি স্থিতিশীল অবস্থান নিয়ে আসার দাবি করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও ভালো হওয়ার আশা করছেন তিনি।
সালেহউদ্দিন বলেন, “আমরা ক্ষমতা নেইনি, দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্বটা এমন একটা সময়ে নিয়েছি, যখন দেশ খাঁদের কিনারায় ছিল। অনেকেই বলেছেন দেশ আইসিইউতে ছিল, বিশেষ করে আর্থিক ব্যবস্থাপনা।
“ফলে আমাদের যাত্রা শুরু হয় সুড়ঙ্গ হাইওয়েতে। আশা করছে এই হাইওয়েটা খুব দ্রুত প্রশস্ত হবে।”
সরকার যে সংস্কারগুলো হাতে নিয়েছে সেটা চলমান বলে মন্তব্য করে সালেহউদ্দিন বলেন, “আমরা যতটুকু পারি করব। আমরা যে পদচিহ্ন রেখে যাব, আশা করছি পরে যারা আসবে তারা সেটা বাস্তবায়ন করবে।“
প্রতিকূল অবস্থা থেকে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি করে তিনি বলেন, “এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা, সামাজিক নিরাপত্তার দিকে নজর দিতে চেষ্টা করেছি।”