Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রথম বাজেটে নতুনত্ব কী?

Icon

আল আমিন

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ২২:৪৪

গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রথম বাজেটে নতুনত্ব কী?

৩ জুন অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট উত্থাপন করে

গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রথম বাজেটে কী থাকে, এ নিয়ে দৃষ্টি ছিল মানুষের। প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে, তা নিয়ে চলছে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। সংস্কার আলোচনার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম যে বাজেট উপস্থাপন করল, তাতে নতুনত্ব কি আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন এরই মধ্যে উঠতে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেটে কর কাঠামো আর উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সংস্কারের উদ্যোগ দেখা যায়নি। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানো এবং ৫৭ হাজার কোটি টাকা বাড়তি কর আদায়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে চলার কথা উল্লেখ করেছেন। 

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তাবিত আয়-ব্যয়ের হিসাবকে ‘দাতাগোষ্ঠীর পরামর্শে প্রণীত ব্রিফকেসবিহীন বাজেট’ আখ্যা দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে এই বাজেটে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ থাকলেও দেশের জনগণের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নেই। 

প্রত্যাশার পাহাড় সরকারের, বাজেটে প্রতিফলন কী

বাংলাদেশের ৫৪টি বাজেটের মধ্যে এবারই প্রথম আগের বছরের চেয়ে আকার ছোট হয়েছে। বরাদ্দ কমেছে সাত হাজার কোটি টাকা। গত বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় উন্নয়ন বরাদ্দ কমেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, এই হিসাবে রাজস্ব ব্যয় কিন্তু বাড়াতে হয়েছে অর্থ উপদেষ্টাকে।

তিনি স্বীকার করেছেন, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে, সে জন্য তিনি মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৫.৫ শতাংশ হবে বলে আশা করছেন। আবার বলেছেন, প্রবৃদ্ধি নয়, সামগ্রিক উন্নয়নেই সরকারের লক্ষ্য। বাজেটে জুলাই যোদ্ধাদের জন্য আলাদা বরাদ্দ রয়েছে। তবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ শতকরা হারে আগের বছরের চেয়ে কমেছে, এটা নিয়ে নাখোশ অর্থনীতিবিদরা। তবে জননিরাপত্তা খাতে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে সুস্পষ্ট ঘোষণা এসেছে বিদ্যুতের দাম আপাতত বাড়বে না, এটি সাধারণ মানুষের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের জন্যও স্বস্তিকর। সেই সঙ্গে চিনি-সয়াবিন তেলের দাম কমানোর লক্ষ্যে কর সুবিধার কথা বলা হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে ২৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে, আগামী জুনের মধ্যে সেটি ৮-এর ঘরে নেমে আসবে বলে আশা করছেন অর্থ উপদেষ্টা। আগামী অর্থবছরে সেটি আরো কমিয়ে ৬.৫-এ নামানোর লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। 

পুরোনো কাঠামো?

অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মনে করেন, পতিত সরকারের কাঠামো থেকে বের হতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। তার মূল্যায়ন, ‘পুরোনো কাঠামোর বাজেটের যে পুঞ্জীভূত সমস্যাগুলো রয়েছে, তা এই বাজেটকে তাড়িয়ে বেড়াবে। বাজেটের কাঠামো পরিবর্তনের যে সুযোগ ছিল, আমার কাছে মনে হয়েছে যে, এই বাজেট সেই সুযোগটা সেভাবে নিতে পারেনি।’ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে গতানুগতিক প্রক্রিয়ার বাইরে এসে ভিন্ন রকমের অগ্রাধিকার দেখার আশায় ছিলেন তিনি। 

বড় অঙ্কের ঘাটতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা

উপদেষ্টা নতুন অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৩.৬ শতাংশে রেখেছেন। রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য রেখেছে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার এই ঘাটতি রেখেছিল দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ এই ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ঋণনির্ভর এই বিশাল ঘাটতি বাজেটে জনগণের অর্থনৈতিক বৈষম্য খুব বেশি কমাবে না। এই ঘাটতি পূরণে দেশি-বিদেশি ঋণ ও সুদের বোঝা আরো বৃদ্ধি পাবে। পরিচালনা ব্যয় ও সুদ পরিশোধের মতো অনুন্নয়ন খাতেই বাজেটের বেশির ভাগ অর্থ ব্যয় হবে। আর বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যাংকিং উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমবে।

অর্থ আসবে কোথা থেকে

অর্থ উপদেষ্টা ঘাটতি কম ধরে যে বাজেট দিয়েছেন, তাতে তিনি চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ে পরিকল্পনা করেছেন। 

এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৩৬ হাজার কোটি টাকা বেশি। অর্থবছরের ১০ মাসে সরকার সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও যেখানে ৭১ হাজার কোটি টাকা পিছিয়েছে, সেখানে আগামী অর্থবছরে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব কীভাবে আসবে, তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা উপদেষ্টা দেননি। তিনি এই রাজস্ব আদায়ের ভার দিয়েছেন এনবিআরকে। অর্থনীতিবিষয়ক গবেষকরা বলছেন, আগামী অর্থবছর নির্বাচনের বছর। দেশের বড় দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মধ্যে পরিস্থিতি যেকোনো সময় ঘোলাটে হয়ে উঠতে পারে। এমনিতেই বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়, তার ওপর পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠলে চলতি অর্থবছরের মতোই রাজস্ব আদায় ফের অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। 

উন্নয়ন বরাদ্দ নিয়ে কী ভাবনা

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উন্নয়ন বাজেট আগের বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ১৩.২ শতাংশ কমানো হয়েছে। এর আগে শতকরা হিসাবে উন্নয়ন বাজেট এতটা কমানো হয়নি কখনো। 

আয়করে চাপ বাড়বে

অর্থ উপদেষ্টা ২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে আয়কর খাতে বাড়তি আদায়ের যে প্রস্তাব করেছেন, তাতে করমুক্ত আয়সীমায় ঢুকলে এক লাখ টাকা পর্যন্ত করহার ৫ শতাংশ থেকে শতভাগ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এভাবে প্রতিটি ধাপে ৫ শতাংশ করে বাড়তি কর আরোহণের কথা বলা হয়েছে। উপদেষ্টা অবশ্য করমুক্ত আয়সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ থেকে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা করেছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘এই সুবিধা খুব কম মানুষই পাবে। বরং চাকরিজীবীদের মধ্যে করের চাপ আরো বাড়বে।’ ২০২৬-২৭ অর্থবছরে আয়কর দাতাদের থেকে আরো বেশি হারে অর্থ আদায়ের পরিকল্পনার কথা বলেছেন অর্থ উপদেষ্টা, যা নিয়ে এরই মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে কর খাতে বড় ধরনের সংস্কার না করে শুধু করহার এদিক-সেদিক করলে করের বোঝা একজনের ওপর থেকে আরেকজনের ওপর গিয়ে পড়বে।’ 

কর্মসংস্থান নিয়ে দিকনির্দেশনা নেই

গবেষক সেলিম রায়হানের মতে, প্রস্তাবিত বাজেটের আরেকটি দুর্বলতা হলো, এখানে কর্মসংস্থানের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এখন স্থবির জায়গায় আছে। সেই স্থবিরতা কাটানো জন্য সুস্পষ্ট কিছু নেই। গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘দেশীয় শিল্পের বিকাশে তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। সব মিলিয়ে এ বাজেট অসংগতিপূর্ণ।’ টেক্সটাইল শিল্পের উদ্যোক্তারা অর্থ উপদেষ্টার একটি প্রস্তাবে নাখোশ। দেশীয় টেক্সটাইল মিলে উৎপাদিত সুতায় ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিনিয়োগ স্থবিরতার মধ্যে বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকার কথা জানিয়ে সমালোচনা করেছেন অর্থনীতির একাধিক বিশ্লেষক। অর্থ উপদেষ্টা যখন বাজেট দিয়েছেন, সে সময় পরিসংখ্যান ব্যুরোর বেকারত্ব নিয়ে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছরে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ, সংখ্যায় যা এক লাখ ৬০ হাজার। 

বিদ্যুৎ নিয়ে স্বস্তির ঘোষণা

অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে নীতিগতভাবে বিদ্যুতের মূল্য আপাতত না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১০ শতাংশ কমানো হবে। এ লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলোও পর্যালোচনা এবং এনার্জি অডিট করার উদ্যোগের কথা বলেছেন তিনি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে বহু বছর আন্দোলন করে আসা আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ কমানো সম্ভব। তবে জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’ এর জন্য এ খাতে বাজেট বাড়ানোর প্রয়োজন জানিয়ে তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘কিন্তু সেটা হয়নি।’ সার্বিক মূল্যায়ন : প্রত্যাশা পূরণ হয়নি আনু মুহাম্মদ বলেন, সংস্কারের যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি। বিগত সরকারের কাঠামো বিদ্যমান আছে। বিশেষ করে জনপ্রশাসন খাতে বাজেট কমানোর প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু এই বাজেট আরো বাড়ানো হয়েছে।

 


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫