Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: সংকটে তেল-গ্যাস, কী হবে বাংলাদেশের?

Icon

নিশাত বিজয় ও ইমরানুর রহমান

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৫, ১২:৫৮

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: সংকটে তেল-গ্যাস, কী হবে বাংলাদেশের?

বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের এক-পঞ্চমাংশ হরমুজ প্রণালি দিয়ে হয়।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের আগুন মধ্যপ্রাচ্য জ্বালিয়ে তুলেছে, আর বাংলাদেশে জ্বালানি সংকটের আভাস নিয়ে এসেছে।

যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে, সেটি বাংলাদেশের জন্য একটি ধাক্কা, আরেকটি শঙ্কার কারণ হরমুজ প্রণালি বন্ধে ইরানের হুমকি, যে প্রণালি দিয়ে বাংলাদেশ তেল ও গ্যাস আমদানি করে থাকে।

জ্বালানি সংকটে পরিবহন ছাড়াও বিদ্যুৎ ও শিল্পে প্রভাব পড়তে পারে। বেড়ে যেতে পারে বিদ্যুৎ বিপর্যয়।

গ্যাস সংকটে থাকা বাংলাদেশে তেলের মজুদ আছে জুলাই পর্যন্ত। সংঘাত না থামলে এবং ইরান যদি সত্যিই এমন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, তাহলে কী হবে, তা জানা নেই সরকারের। অন্যদিকে গ্যাসবাহী জাহাজ আসে প্রতি সপ্তাহে। এক সপ্তাহ না এলেই দেখা দেয় সমস্যা।

জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এ জন্যই এই যুদ্ধকে ‘বাংলাদেশের জন্যও দুঃসংবাদ’ বলেছেন। জানিয়েছেন, যে তেল মজুদ আছে, তা দিয়ে আর মাস দেড়েক চলা যাবে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি বছরে যে ৮০ লাখ টনের বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে, তার ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। জ্বালানিবাহী ট্যাংকার জাহাজগুলো হরমুজ প্রণালি পাড়ি দিয়েই আসে।

বাংলাদেশ বছরে যে ৫ থেকে ৬ মিলিয়ন টন তরল গ্যাস বা এলএনজি আমদানি করে, সেটিও এই প্রণালি দিয়ে আসে।

বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের এক-পঞ্চমাংশ এই প্রণালি দিয়ে হয়। ইরান (উত্তরে) এবং ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (দক্ষিণে)–এর মাঝখানে অবস্থিত এই প্রণালি মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাস রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ করিডোর হিসেবে কাজ করে।

যেকোনো সময়ে প্রণালিতে ডজনখানেক তেলবাহী ট্যাংকার ঢুকছে বা বের হচ্ছে, এবং এখান থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি সরবরাহ হয়।

ইরানে ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষিতে দেশটির পার্লামেন্টের নিরাপত্তা কমিটির সদস্য ইসমাইল কোসারি স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, পারস্য উপসাগরে প্রবেশের একমাত্র পথ হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে তার দেশ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “যুদ্ধ যদি স্বল্পমেয়াদি হয়, আর আমাদের যে মজুদের সক্ষমতা, তাতে সংকটে পড়ব না। তবে ইরাক-ইরান যুদ্ধের মতো দীর্ঘমেয়াদি লড়াই হলে যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ আছে। সে সময় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। 

“বাংলাদেশ যেহেতু আমদানিনির্ভর দেশ, যুদ্ধ চলমান থাকলে একই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।”

বিকল্প কী, কী প্রভাব

প্রণালিটি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশকে ভারত বা মালয়েশিয়া থেকে পরিশোধিত তেল আমদানি করে সংকট মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু তা হবে ব্যয়বহুল।

ভারত থেকে বাংলাদেশ এখন বছরে ১ লাখ ৩০ হাজার টনের মতো পরিশোধিত ডিজেল আমদানি করে যা দেশের মোট চাহিদার ৩ শতাংশের মতো। আবার হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে ভারতের পক্ষেও এই ডিজেল সরবরাহ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ, ভারতও এই প্রণালি ব্যবহার করেই আমদানি করে তেল পরিশোধন করে। 

প্রণালিটি বন্ধ না হয়ে যদি অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে শিপিং কোম্পানিগুলোর বিমা খরচ বাড়বে। তাতেও ব্যয় বাড়বে দেশের। 

বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বিকল্প পথে আমদানির জন্য লোহিত সাগর ও আরব সাগরের রুট বিবেচনায় রাখছে।”

তবে লোহিত সাগরও সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। এর আগেও ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হামলায় এই রুট দিয়ে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে। 

ফলে বর্তমানে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য রুট হিসেবে দেখা হচ্ছে আরব সাগরকে।

বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “জাহাজগুলোকে দীর্ঘ রুট নিতে হলে স্বাভাবিকভাবেই পরিবহন খরচ বাড়াবে।”

জ্বালানি উপদেষ্টা সতর্ক

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “ইসরায়েল-ইরানের যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদ। কারণ আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা অনেকটাই আমদানির ওপর নির্ভরশীল। 

“আমি মনে করি তাৎক্ষণিকভাবে বড় কোনো সংকট নেই। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না গেলে আমরা অনেকটা নিরাপদ।”

বাংলাদেশের মজুদ কত দিনের

বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ দিনের জ্বালানি তেলের মজুদ থাকে। সাধারণত দেশে এক সময় প্রায় ৪ লাখ টন তেল মজুদ থাকে।

বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও পরিচালনা) মণি লাল দাস দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত তেল পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৪ লাখ টন আসে সৌদি আরব ও আবুধাবি থেকে। 

মোট ১৪টি ট্যাংকারের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয়।

এছাড়া সরকার টু সরকার চুক্তির আওতায় বিপিসি আটটি দেশের সঙ্গে পরিশোধিত তেল আমদানি করে।

জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, “জুন-জুলাইয়ের জন্য যে তেলের শিপমেন্ট সেটা ওই এলাকা (হরমুজ প্রণালি) ছেড়ে এসেছে। তাই জুলাই পর্যন্ত চিন্তার কিছু নেই।”

বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশের বার্ষিক জ্বালানি চাহিদা—যার মধ্যে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, ফার্নেস অয়েল, মেরিন ফুয়েল ও জেট ফুয়েল রয়েছে—প্রায় ৭২ লাখ টন। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের তেল পরিশোধন ও মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো উচিত ছিল। এটি যদিও ব্যয়বহুল প্রকল্প, কিন্তু এতে দীর্ঘমেয়াদে সুফল পাওয়া যেত।”

তেলের দামও বাড়বে?

তেহরানের হুমকি ও চলমান সংঘাতের কারণে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১০ শতাংশের মতো বেড়ে গেছে এরই মধ্যে। সংঘাত না থামলে তা আরও বেড়ে যাবে বলেও আশঙ্কার কথা লেখালেখি হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে। 

রবিবার ব্রেন্ট ক্রুড ফিউচারস ৯.০৭ শতাংশ বা ৬.২৯ ডলার বেড়ে প্রতি ব্যারেল ৭৫.৬৫ ডলারে পৌঁছেছে। এক পর্যায়ে দাম গিয়ে ঠেকে ৭৮.৫০ ডলারে, যা ২৭ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা ঘিরে বাজারে নতুন করে ‘রিস্ক প্রিমিয়াম’ যুক্ত হয়েছে। যুদ্ধের ঝুঁকিতে থাকায় সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কায় এই মূল্যবৃদ্ধি।

হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলার স্পর্শ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। পরিশোধিত তেলের বাজারেও এর প্রভাব পড়বে।

গত সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য নতুন পারমাণবিক চুক্তির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এতে তেলের বাজার কিছুটা স্থির হয়। তবে শুক্রবারের ইসরায়েলি হামলায় বাজারে ফের অস্থিরতা দেখা দেয়।

তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি বাংলাদেশের ভোক্তার জন্য চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ, তেলের মূল্য নির্ধারণ এখন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের শর্ত মেনে এই পরিবর্তনের পর থেকে প্রতি মাসেই তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হচ্ছে।

জ্বালানি উপদেষ্টাও বলেন, “যদি তেলের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে আমাদের জন্য সমস্যা হবে।”

বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করি। মাসের গড় মূল্য বিবেচনায় নিয়ে আমরা প্রতি মাসে মূল্য সমন্বয় করি। পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।”

গ্যাস আমদানির কী হবে

বাংলাদেশ নিজস্ব গ্যাসের উৎপাদন দিয়ে মোট চাহিদার প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পূরণ করে। বাকি ঘাটতি মেটাতে সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস-এলএনজি আমদানি করে।

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে বছরে ৩৫ লাখ টনের মতো এলএনজি আমদানি করে। অন্যদিকে স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করে আরও ১৫ থেকে ২৫ লাখ টনের মতো। 

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর স্পট মার্কেটে গ্যাসের দাম ইউনিটপ্রতি ১০ ডলার থেকে বাড়তে বাড়তে ৩০ ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ২০২২ সালের জুনে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক লোডশেডিং দেখা দেয়। এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ক্ষুব্ধ হয় মানুষ।

বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে গ্যাসের দাম বাড়ার রীতিও রয়েছে। ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের কারণে এশিয়ান এলএনজি মার্কেটের মূল্য সূচক এরই মধ্যে ১১ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরবরাহ ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।

আমদানিকৃত গ্যাস পুনরায় তরলে রূপান্তর করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হয়—ফেনী ও মহেশখালীতে দুটি ভাসনাম টার্মিনাল দিয়ে।

বাংলাদেশ চাহিদার কেবল ৩ থেকে ৫ দিনের সমান এলএনজি মজুদের সুবিধা আছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “আমাদের তো গ্যাসের কার্গো আসে। দুটি জাহাজ দিয়ে এক মাসের চাহিদা পূরণ করা যায়। এখন সংঘাত যদি এক মাসের বেশি সময় ধরে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হবে।”

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫