
ইসরায়েল ও ইরানের সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিতে কালো ছায়া ফেলেছে
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান প্রাণঘাতী হামলা-পাল্টাহামলা মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। একের পর এক ব্যালিস্টিক মিসাইল ও ড্রোন হামলা আর পালাবদলের সামরিক কৌশলে অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী অঞ্চল হওয়ায় এই সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিতে কালো ছায়া ফেলেছে।
১৪ জুন ইরানের গ্যাসক্ষেত্রে হামলা চালায় ইসরায়েল। তার এক দিন আগেই ইসরায়েল আকস্মিক হামলা চালিয়ে ইরানের শীর্ষস্থানীয় সামরিক ও পারমাণবিক ব্যক্তিদের হত্যা করে এবং কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। জবাবে ইরানও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। এর কিছু অংশ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম হয়। এই সংঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে তেহরানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, পরবর্তী হামলা আরো ভয়ংকর হবে।
যখন মধ্যপ্রাচ্যের দুই সামরিক শক্তিধর দেশের সংঘাত পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে, তখন বৈশ্বিক আর্থিক বাজার এবং বিমান চলাচল খাতেও এর বড় প্রভাব পড়ছে। তেলের দামে ব্যাপক ওঠানামা দেখা যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ পুঁজিবাজার ছেড়ে স্বর্ণের মতো নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ঝুঁকছেন। ১৬ জুন সকালে বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭৪.৬০ ডলারে দাঁড়ায়, যা ১২ জুনের তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এই অঞ্চলের সংকীর্ণ হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবহন হয়। এখানকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তেলের দাম দ্রুত বাড়বে।’
ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠায় হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি এখন তেহরানের বিবেচনায় রয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, দেশটির পার্লামেন্টের একজন প্রভাবশালী সদস্য ইসমাইল কোসারি বলেছেন, ‘যুদ্ধের মাত্রা বাড়তে থাকলে এই কৌশলগত জলপথ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে তেহরান।’ সমুদ্রপথে রপ্তানি হওয়া বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ তেল যাতায়াত করে এই প্রণালি দিয়েই। ফলে সেখানে সামান্য গোলযোগও তেলের বাজারে বড়সড় ঢেউ তুলতে পারে।
বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, হরমুজ প্রণালিতে যদি সত্যিই অবরোধ তৈরি হয়, তবে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের ঘর ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা এখনই এই আশঙ্কাকে খুব বেশি বাস্তবসম্মত বলে মনে করছেন না। ইতিহাস বলছে, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চলা রক্তক্ষয়ী ইরান-ইরাক যুদ্ধে উপসাগরীয় জাহাজ রুট বারবার হামলার মুখে পড়লেও হরমুজ প্রণালি কখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তেল সরবরাহের লাইফলাইন হিসেবে এটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই পথ আটকে গেলে তেহরান নিজের রপ্তানিকেও বিপন্ন করে ফেলবে, বিশেষ করে তাদের প্রধান ক্রেতা চীনের বাজারে। টিএস লম্বার্ডের অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হামজাহ আল গাউদ বলেন, ‘হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রতিক্রিয়া তেহরানের জন্যই মারাত্মক হবে।’ রাজস্ব হারানো, কূটনৈতিক চাপ আর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই তিনি এমনটি বলছেন।
এদিকে বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, তেলের দাম বেড়ে গেলে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দামও বাড়বে। এতে বিশেষ করে খাদ্য, বস্ত্র ও রাসায়নিকের মতো পণ্যে ভোক্তাদের ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলো মুদ্রাস্ফীতির চাপ ও ধীরগতির প্রবৃদ্ধিতে পড়বে। শেয়ারবাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। ১৩ জুন ওয়ালস্ট্রিটে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ এবং নাসডাক সূচক যথাক্রমে ১.১ শতাংশ ও ১.৩ শতাংশ কমেছে। মিশরের ইজিএক্স ৩০ সূচক কমেছে ৭.৭ শতাংশ এবং ইসরায়েলের তেল আবিব সূচক কমেছে ১.৫ শতাংশ। ইউরোপের শেয়ারবাজারও নিচের দিকে গেছে। তবে প্রতিরক্ষা খাতে কিছু কোম্পানি লাভবান হয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা ঠিকাদার বিএই সিস্টেমসের শেয়ার প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে লকহিড, নর্থরপ গ্রামেন ও আরটিএক্সের শেয়ারও বেড়েছে। তেলের কোম্পানি বিপি ও শেলের দামও বেড়েছে। পাশাপাশি স্বর্ণের দামও বাড়ছে।
১৩ জুন স্বর্ণের দাম বেড়ে প্রতি আউন্সে তিন হাজার ৪২০ ডলারে লেনদেন হয়েছে, যা এপ্রিলের সর্বোচ্চ দামের কাছাকাছি। বিমান চলাচলেও বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ ও ইতিহাদের মতো বড় এয়ারলাইনগুলো রুট পরিবর্তন করেছে বা ফ্লাইট বাতিল করেছে। ইরান, ইরাক ও জর্ডান তাদের আকাশপথ বন্ধ রেখেছে, যা ইউরোপ উপসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রুটে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের উত্তেজনা দীর্ঘ মেয়াদে পর্যটন ও বিনিয়োগের ওপর প্রভাব ফেললেও তা ধীরে ধীরে আবারও নিশ্চয়ই স্বাভাবিক হবে। তবে কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না, এই সংঘাতের শেষ কোথায়