Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াবে এনবিআর

Icon

আল আমিন

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ১৪:৩৮

রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াবে এনবিআর

এনবিআর ভবন

এ বছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। বৃহস্পতিবার কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এই তাগিদ দেন।

এ ছাড়া টার্গেট ভিত্তিক রাজস্ব আদায় এবং বকেয়া আদায়ের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এনবিআর প্রধান বলেন, “রাজস্ব বেশি আদায় করা মানে দেশের ঋণ কমিয়ে আনতে সহায়তা করা।”

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সবশেষ বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার চতুর্থ মাসে সেই লক্ষ্যমাত্রা ১৬ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করে।

গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে বাকি এক মাসে (জুনে) আদায় করতে হবে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এই এক মাসে যদি রাজস্ব আয় বাড়ানো না যায় তাহলে রেকর্ড ঘাটতির মুখে পড়তে হতে পারে এনবিআরকে।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে উন্নয়ন প্রকল্প কাঁটছাট, প্রকল্প বাতিল ছাড়াও সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যেতে পারে।

সাধারণত এনবিআর প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা কর আদায় করতে পারে। তবে বছরের শেষ মাসে সাধারণত কিছু বেশি অর্থ আদায় করা যায়।

সে হিসেবে এনবিআর আশা করছে চলতি অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত তারা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে পারবে।

বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “রাজস্ব আদায়ের গতি চলতি মাসে অব্যাহত থাকলে এই বছর রাজস্ব ঘাটতি রেকর্ড পরিমাণে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো হতে পারে।”

লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে থাকলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশ। এটিও অবশ্য গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এমনকি করোনাভাইরাস মহামারীর বছর ২০২০-২১ অর্থবছরেও ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

প্রভাব কী হতে পারে

রাজস্ব আদায়ে বিপুল পরিমাণ ঘাটতির প্রভাব কী হতে পারে, এই প্রশ্নে অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, “উন্নয়ন প্রকল্পে বঘাটতি মেটাতে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে। এমনকি এর জন্য অনেক উন্নয়ন প্রকল্প কাঁটছাটও করতে হতে পারে।”

কেন এই অবস্থা

২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পবির্তনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের মন্দা, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতা এবং ব্যাংক খাতের অস্থিরতাকে এ ঘাটতির পেছনে দায়ী করা হচ্ছে।

এই পিছিয়ে থাকার মধ্যেই আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা।

কর্মকর্তারা বলছেন, এই নতুন লক্ষ্যমাত্রাও বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কারণ যদি এ বছরের আদায় হয় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, তাহলে এনবিআরকে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।

এনবিআর কর্মকর্তারা সাধারণত রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে নাম প্রকাশ করে কোনো বক্তব্য দেয় না। সংস্থাটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, “বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-এর দুর্বল বাস্তবায়ন ও কাটছাঁটও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।”

অন্য একজন জ্যেষ্ঠ কর কর্মকর্তা বলেন, “ব্যাংকগুলো বড় করদাতা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ বিষয়ে প্রভিশন সংক্রান্ত নীতিমালার কারণে তাদের লাভের হার কমে গেছে। এ কারণেও সরকার তুলনামূলক কম অর্থ পেয়েছে

এই পিছিয়ে থাকার কারণ কী- এই প্রশ্নে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “বছরের প্রথম প্রান্তিকে গণঅভ্যুত্থান এবং শেষ প্রান্তিকে এনবিআর কর্মীদের আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটেছে।”

উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে অনেক পণ্যে কর ছাড় দিতে হয়েছে, এটিও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির একটি কারণ বলেও মনে করেন এনবিআরের সাবেক সদস্য (করনীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম।

গত রোজায় নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে ভোজ্যতেলে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, আমদানি করা অনেক পণ্যে কর ছাড় বা শূন্য কর সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল; ভোজ্যতেলের কর অব্যাহতি মেয়াদ শেষে আর বাড়ানো না হলেও অনেক নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে সর সুবিধা এখনও চালু আছে।

কোন খাত থেকে কত আদায়

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে শুল্ক কর বিভাগ থেকে রাজস্ব আদায় করেছে ৯২ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরের একই সময় এখান থেকে আদায় হয়েছিল ৯১ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা।

এ সময়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে আদায় হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, যা গত বছর ছিল এক লাখ ১৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা।

অন্যদিকে আয়কর বিভাগ থেকে আয় হয়েছে এক লাখ ৭ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা, যাগত বছর ছিল এক লাখ ৮৫৭ কোটি টাকা।

আদায় ‘সামর্থ্যের অর্ধেকেরও কম’

বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় কর আদায় অর্থাৎ কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে। সাম্প্রতিক সময়ে এ অনুপাত আরও কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর কর-জিডিপি অনুপাত ১৯ শতাংশেরও বেশি।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ ‘সামর্থ্যের অর্ধেকেরও কম’। এ কারণে অবকাঠামো উন্নয়ন, পুঁজি গঠন, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজস্ব আহরণ না বাড়ার কারণ কর ফাঁকি, কর ছাড়, কর আদায়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার ও পুরো প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা।

করদাতাদের আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবকেও বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদেরা। অনেকেই মনে করেন, তাদের পরিশোধিত কর যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে না।

কর আদায়ে দুর্নীতি এবং কার্যকর পদ্ধতির অভাবও প্রক্রিয়াটি জটিল করেছে বলেও নানা সময় মত উঠে এসেছে।

করের আওতায় আসা উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা এখনও বাস্তবতার তুলনায় অনেক কম বলে সরকারের তরফেই বক্তব্য এসেছে।

আয়করের বদলে ভ্যাট ও শুল্কের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা সুষম রাজস্ব প্রবাহের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে বলেও একাধিক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫