
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে
রাজনৈতিক অস্থিরতার বছরেও বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মীরা ঝলক দেখিয়েছেন। রাজনৈতিক পালাবদলের অর্থবছরে নানা ধরনের সংকটের মধ্যেও তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পেছনে মূল ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজার।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি ৮ শতাংশের কিছু বেশি বাড়লেও, দেশের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেড়েছে ১৫ শতাংশেরও বেশি, ইউরোপে বেড়েছে ১১ শতাংশের কাছাকাছি।
বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান খাত যেমন তৈরি পোশাক, তেমনি তৈরি পোশাকেরও প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। সেখানে চাহিদার উত্থান-পতন বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
এই রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে অন্যান্য বাজারে—বিশেষ করে রাশিয়া, কোরিয়া ও আরব অঞ্চলে—ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির চাপ সামলে নেওয়া গেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)–এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশের পোশাক পণ্য বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে যায়। এর প্রায় ৭৭ শতাংশ রপ্তানি হয় শীর্ষ ১০টি দেশে—যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, ইতালি, কানাডা ও জাপান।
প্রতিটি বাজারে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়।
এই ১০ দেশে গোটা অর্থবছরের রপ্তানির আলাদা পরিসংখ্যান এখনো প্রকাশ না হলেও, অর্থবছরের ১১ মাসের হিসাব প্রকাশ পেয়েছে।
এই ১১ মাসে ১০টি দেশে রপ্তানি হয়েছে ২৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক, প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১০ শতাংশ—যা সার্বিক রপ্তানির তুলনায় বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে দারুণ প্রবৃদ্ধি
একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির বৃহত্তম বাজার, যেখানে ১১ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৭ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার—গত বছরের তুলনায় ১৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি।
কানাডা ও যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয়েছে যথাক্রমে ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার ও ৪ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার, যা প্রথম ১১ মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যথাক্রমে ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনও শীর্ষ বাজার
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই অঞ্চলেই অর্থবছরের ১১ মাসে রপ্তানি হয়েছে ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা মোট পোশাক রপ্তানির ৪৯ দশমিক ৯১ শতাংশ।
গত বছরের একই সময়ে এই অঞ্চলে রপ্তানি ছিল ১৬ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। রপ্তানি হয়েছে সাড়ে ১০ শতাংশের বেশি।
ইউরোপের মধ্যে জার্মানি সর্বোচ্চ রপ্তানি বাজার হিসেবে রয়েছে শীর্ষে, যেখানে ১১ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৪ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর রয়েছে স্পেনে ৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ও ফ্রান্সে ২ বিলিয়ন ডলার।
অপ্রচলিত বাজারও চাঙ্গা
অপ্রচলিত বাজারেও পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এই বাজারগুলোতে রপ্তানি হয়েছে ৬ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির ১৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এর মধ্যে তুরস্কে রপ্তানি বেড়েছে ৩১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ভারতে ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং জাপানে ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ।
তবে ইপিবির তথ্য বলছে, অর্থবছরের ১১ মাসে রাশিয়া, কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি কমেছে।
চাহিদা বেশি নিট পোশাকের
২০২৪–২৫ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি নিট পোশাক—অর্থাৎ সাধারণভাবে গেঞ্জির কাপড় হিসেবে পরিচিত এই ধরনের পোশাকের চাহিদা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
এই খাত থেকে আয় হয়েছে ২১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
অন্যদিকে ওভেন পোশাক থেকে আয় হয়েছে ১৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।
তবু আক্ষেপ
রাজনৈতিক পালাবদলের বছরে যেখানে শতাধিক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে সরকার স্বস্তিতে থাকলেও তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক শেখ এইচ. এম. মোস্তাফিজ আক্ষেপ করেছেন।
তিনি বলেন, “অর্থবছরের শুরুতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক মাসের বেশি সময় শ্রম অস্থিরতার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়। সেটি না হলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ হতো।”
বাংলাদেশের সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা বাড়ছে। বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীন থেকেও ক্রয়াদেশ স্থানান্তরের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এটিকে সম্ভাবনা হিসেবে দেখিয়ে মোস্তাফিজ আরও বলেন, “গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট সামাল দেওয়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ ও দক্ষতা উন্নয়নে জোর দিতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তা না হলে আগামী দিনে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমরা পিছিয়ে পড়ব।”
তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “টিকে থাকতে হলে আমাদের অবশ্যই প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি নতুন বাজারে প্রবেশ এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণই হবে ভবিষ্যতের মূল কৌশল।”