
রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ। ফাইল ছবি
আকাশপথে যাত্রী সংখ্যা যেখানে ক্রমেই বাড়ছে, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আকাশ ছোট হয়ে আসছে। উড়োজাহাজ সংকটে ভুগতে থাকা রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থাটিকে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ অনেক রুট বন্ধ করে দিতে হয়েছে। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ফ্লাইট বাড়ানো যাচ্ছে না মধ্যপ্রাচ্যের মতো লাভজনক গন্তব্যেও।
এ অবস্থায় বিমান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সময়মতো লিজ কিংবা নতুন উড়োজাহাজ কিনতে না পারার কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। দ্রুত এর সমাধান না হলে বিমান তার বাজার হারাতে পারে।
উড়োজাহাজ সংগ্রহের দুটি উপায় রয়েছে: একটি হলো লিজ নেওয়া, অন্যটি নতুন উড়োজাহাজ কেনা। তবে নতুন কিনতে গেলে তা হাতে পেতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। ফলে দ্রুততার সঙ্গে উড়োজাহাজ সংগ্রহের একমাত্র কার্যকর উপায় হচ্ছে লিজ।
বর্তমানে বিমানের বহরে রয়েছে ২১টি উড়োজাহাজ। এর মধ্যে দুটি বোয়িং ৭৩৭ লিজ মেয়াদ শেষে বহর থেকে বাদ পড়ায় বর্তমানে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯টিতে। বর্তমান বহরে রয়েছে—চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার, দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার, চারটি বোয়িং ৭৩৭ এবং পাঁচটি ড্যাশ ৮-৪০০।
বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ ও বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “বিশ্বব্যাপী যে হারে যাত্রী বাড়ছে, সেই হারে বিমানের প্রস্তুতি নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ড্রাই লিজে (কেবল উড়োজাহাজ) উড়োজাহাজ পাচ্ছে না বিমান।”
ওয়েট লিজে (পাইলট ও ক্রুসহ) উড়োজাহাজ নিলে খরচ অনেক বেশি পড়ে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় লিজের উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই নতুন উড়োজাহাজ ছাড়া বিমান বাজারে টিকে থাকতে পারবে না।”
অলাভজনক রুটের প্রভাব
বিমানের বিপণন বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, অনেক দিন ধরেই মার্কেটিং বিভাগের পক্ষ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের লাভজনক জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মামের মতো রুটে ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানোর সুপারিশ করা হচ্ছিল। কিন্তু পূর্ববর্তী সরকার এই পথে না গিয়ে রোম, নারিতা ইত্যাদি রুট চালু করে।
তিনি বলেন, “বিমান প্রথম উড়োজাহাজ সংকটে পড়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা-টরেন্টো, ঢাকা-নারিতা ও ঢাকা-রোম ফ্লাইট চালুর মধ্য দিয়ে। এরপর এ বছর হজের আগে এই সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করে।”
হজ ফ্লাইট নির্বিঘ্ন রাখতে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা-ম্যানচেস্টার ফ্লাইট স্থগিত করা হয়। এরপর ১ জুলাই থেকে ঢাকা-নারিতা ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দেয় বিমান।
হজের আগে বিমান দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ লিজে নেওয়ার চেষ্টা করে। এজন্য একাধিকবার দরপত্র আহ্বান করেও উড়োজাহাজ পেতে ব্যর্থ হয় তারা।
এর মধ্যেই বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি আগামীতে সিডনি ও মালেতে নতুন ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনা করছে।
নতুন উড়োজাহাজ সংগ্রহ কত দূর
বিমান বিপণন বিভাগের ওই কর্মকর্তা বলেন, “বিগত সরকারের সময়ে এয়ারবাস কেনার প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে ছিল। এখন সেটি আর এগোচ্ছে না। নতুন করে আবার বোয়িং ও এয়ারবাসের প্রস্তাব পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও, চুক্তি শেষে নতুন উড়োজাহাজ হাতে পেতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে।”
২০১০ সালে বিমান একযোগে ১২টি নতুন উড়োজাহাজ সংগ্রহ করেছিল। এরপর আরও দুটি ড্রিমলাইনার ও দুটি ড্যাশ ৮-৪০০ যুক্ত হয় বহরে। তবে গত ১৫ বছরে নতুন কোনো উড়োজাহাজ সংগ্রহ করতে পারেনি রাষ্ট্রীয় এই এয়ারলাইন্স।
এক সময় বিমানের বহরের নির্ভরযোগ্য ফ্লিট ছিল ডিসি-টেন উড়োজাহাজ। এগুলো দীর্ঘদিন বিমানের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে ছিল। তবে পরবর্তীতে পুরনো ও জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়ায় এগুলো বহর থেকে বাদ দেওয়া হয়।
২০১১ সাল থেকে বিমানের বহরে যুক্ত হতে থাকে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ।
• চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর যুক্ত হয়: ২০১১ সালের অক্টোবরে, নভেম্বরে এবং ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে।
• দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ যুক্ত হয়: ২০১৫ সালের নভেম্বরে ও ডিসেম্বরে।
• তিনটি বোয়িং ৭৮৭-৮ যুক্ত হয়: ২০১৮ সালের আগস্ট, ডিসেম্বর এবং ২০১৯ সালের আগস্টে।
• আরও দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ও একটি বোয়িং ৭৮৭-৮ যুক্ত হয়: ২০১৯ সালের মে, জুন এবং সেপ্টেম্বরে।
• সর্বশেষ ২০২০ ও ২০২১ সালে যুক্ত হয় নতুন পাঁচটি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ।
বিগত সরকারের সময়ে বিমানের বহর পরিকল্পনা কমিটি ২০৩৫ সালের মধ্যে নতুন ৪৬টি উড়োজাহাজ সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেই পরিকল্পনাকে নতুন করে সাজাতে চাইছেন। তবে এখনও তার পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়নি।
বড় হচ্ছে বাজার
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)–এর একটি হিসেব অনুযায়ী, আগামী ১০ বছরে দেশের আকাশপথে যাত্রী সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। বর্তমানে বছরে গড়ে ১ কোটি ২৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন; ২০৩৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৫০ লাখে।
বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “এই বাজার ধরতে আগেভাগেই প্রস্তুত হতে হবে। ভারতের এয়ার ইন্ডিয়া ৫০০টি উড়োজাহাজ অর্ডার দিয়েছে। আমাদের সমসাময়িক সময়ে স্বাধীন হওয়া ভিয়েতনামের রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্সের বহর বিমানের পাঁচ গুণ বড়। তাই বিমানকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে যেভাবে বাজার শেয়ার হারাচ্ছে, তাতে এক সময় এটি তলানিতে ঠেকবে।”
বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) রওশন কবীর দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “নতুন উড়োজাহাজ সংগ্রহের জন্য বিমান ইতোমধ্যে বোয়িং ও এয়ারবাসের ১৪টি করে মোট ২৮টি উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিমানের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিচালনা পর্ষদ বিষয়টি চূড়ান্ত করবে।”