ট্রাম্পের শুল্কনীতি নতুন অনিশ্চয়তায় ট্রান্স-আটলান্টিক বাণিজ্য

তৌসিফ আহমেদ
প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৫, ১৩:১২

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির দাবা বোর্ডে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক এক জটিল অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ইউরোপীয় আমদানির ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি এবং এর জবাবে ইইউয়ের পাল্টা ব্যবস্থা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত-এই দুটি ঘটনা নিছক কোনো বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ নয়; বরং এটি এক গভীর কৌশলগত লড়াই এবং অর্থনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধের ইঙ্গিত বহন করে। এই টানাপোড়েন শুধু শুল্কের হার নির্ধারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং এটি ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল, বিনিয়োগের গতিপ্রকৃতি এবং মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ তার সুপরিচিত ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিরই একটি ধারাবাহিক প্রতিফলন।
১ আগস্ট থেকে শুল্ক কার্যকরের হুমকি দিয়ে তিনি আলোচনার টেবিলে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করার একটি ক্লাসিক কৌশল নিয়েছেন। তার এই পদক্ষেপের পেছনে দ্বিমুখী উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল। প্রথমত, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেকে একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা, যিনি মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় কোনো ছাড় দিতে নারাজ। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইইউকে চাপে ফেলে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরো অনুকূল শর্ত আদায় করা। তবে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে এমন বিস্তৃত শুল্ক আরোপের হুমকি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মাবলির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এটি একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপনের ঝুঁকি তৈরি করে। এই শুল্ক কার্যকর হলে তা কেবল ইউরোপীয় রপ্তানিকারকদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং মার্কিন ভোক্তাদের ওপরও মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়াবে, কারণ আমদানীকৃত পণ্যের দাম অনিবার্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত পরিমাপিত ও কৌশলপূর্ণ। কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত আগস্টের শুরু পর্যন্ত স্থগিত করে মূলত একটি কৌশলগত বিরতি নিয়েছেন। এটিকে দুর্বলতা হিসেবে দেখার সুযোগ কম। বরং এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্রাসেলস একাধিক লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছে। প্রথমত, আলোচনার জন্য একটি কূটনৈতিক জানালা খোলা রাখা এবং বিশ্বমঞ্চে নিজেদের যৌক্তিক ও দায়িত্বশীল পক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা। দ্বিতীয়ত, তারা দেখাতে চাইছে যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার দায় তাদের নয়। তৃতীয়ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই সময়টুকু কাজে লাগিয়ে জোটের ২৭টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সমন্বিত ও শক্তিশালী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা। জার্মানির মতো রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির দেশ যেখানে আলোচনার ওপর জোর দেয়, সেখানে ফ্রান্সের মতো দেশগুলো প্রায়ই কঠোর অবস্থানের পক্ষে থাকে। এই স্থগিতাদেশটি ভন ডার লিয়েনকে একটি ঐক্যবদ্ধ ইউরোপীয় কৌশল প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিয়েছে। তার বার্তা স্পষ্ট, আলোচনার দরজা খোলা, কিন্তু প্রস্তুতি চূড়ান্ত। যদি দরকষাকষি ব্যর্থ হয়, তবে পাল্টা ব্যবস্থা হবে সুচিন্তিত ও কার্যকর।
এই ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অর্থনৈতিক প্রভাব এরই মধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। ট্রাম্পের ঘোষণার পর মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইউরোর মানে অবমূল্যায়ন ঘটেছে, যা বাজারের প্রাথমিক ভীতি ও অনিশ্চয়তার প্রতিফলন। বিনিয়োগকারীরা এখন একটি দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে রয়েছেন। একদিকে তারা দীর্ঘায়িত বাণিজ্যযুদ্ধের ঝুঁকি আঁচ করতে পারছেন, যা বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। অন্যদিকে তারা আশা করছেন যে এটি হয়তো আলোচনার একটি কৌশল মাত্র এবং শেষ পর্যন্ত একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে। এই অনিশ্চয়তা সরাসরি ব্যাবসায়িক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। যেসব সংস্থা ট্রান্স-আটলান্টিক সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে জার্মানির অটোমোবাইল শিল্প, ফ্রান্সের বিলাসবহুল পণ্য এবং ইউরোপের কৃষি খাত, তারা এখন সম্ভাব্য ঝুঁকির জন্য প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা, উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো আপাতত স্থগিত রাখা হচ্ছে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ধীর করে দিতে পারে। সামনের দিনগুলোতে এই পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। প্রথমত, ব্রাসেলস ও ওয়াশিংটনের মধ্যে পর্দার আড়ালে আলোচনা কতটা ফলপ্রসূ হয়। দ্বিতীয়ত, ইউরোপকে নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্প এই বাণিজ্য ইস্যুটিকে কতটা ব্যবহার করেন। তৃতীয়ত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কতটা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি সাধারণ অবস্থান ধরে রাখতে পারে। আপাতত, দুই পক্ষই তাদের প্রতিপক্ষের পরবর্তী চালের জন্য অপেক্ষা করছে। আগামী কয়েক সপ্তাহ কেবল শুল্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না, বরং এটি একবিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন এই উচ্চ ঝুঁকির দাবা খেলার ফলাফলের দিকেই তাকিয়ে আছে।