ক্রিপ্টোতে বৈশ্বিক নেতা হতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

মো. ইমরানুর রহমান
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৫, ১৬:৩৯

প্রতীকী ছবি।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস গত সপ্তাহে তিনটি ঐতিহাসিক ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ক বিল পাস করেছে, যা দেশটিকে ক্রিপ্টো শিল্পের নেতৃত্বে নিয়ে যাওয়ার বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বাক্ষর করেছেন, বাকি দুটি এখন সিনেটে পাসের অপেক্ষায় রয়েছে।
কয়েন টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের ‘ক্রিপ্টো রাজধানী’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। এই লক্ষ্যেই তিনি পুরো সপ্তাহটিকে ‘ক্রিপ্টো উইক’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তার প্রশাসনের এই সক্রিয়তা বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টো ইন্ডাস্ট্রির ওপর প্রভাব ফেলছে।
জিনিয়াস অ্যাক্ট : স্টেবলকয়েনের জন্য আইনগত কাঠামো
হাউসে পাস হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিলটির নাম ‘জিনিয়াস অ্যাক্ট’। এটি মূলত স্টেবলকয়েনের মতো ডিজিটাল মুদ্রার জন্য প্রাথমিক বিধিবিধান, গ্রাহক সুরক্ষা এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করবে। বিলটি হাউসে ৩০৮-১২২ ভোটে পাস হয় এবং আগেই সিনেটে পাস হয়েছিল, যা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দুই দলেরই সমর্থন পেয়েছে।
স্টেবলকয়েন হলো এমন ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি, যা মার্কিন ডলারের মতো স্থিতিশীল কোনো সম্পদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, যাতে এর মূল্য ওঠানামা কম হয়। এগুলো সাধারণত ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার বাড়ছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় স্টেবলকয়েনগুলোর মধ্যে রয়েছে টেথার বা ইউএসডিটি, ইউএসডিসি ও ডাই। হাউস ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেস কমিটির চেয়ারম্যান ফ্রেঞ্চ হিল এই বিল নিয়ে বলেন, ‘এই বিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা বজায় রাখবে এবং ভোক্তাদের জন্য শক্তিশালী সুরক্ষা দেবে। বিশ্বব্যাপী অর্থ প্রদানের পদ্ধতি একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই আইন সে ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।’
দ্বিতীয় বিল : ডিজিটাল সম্পদের শ্রেণিবিন্যাস
দ্বিতীয় বিলটি মূলত ডিজিটাল সম্পদ ও ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য নতুন মার্কেট স্ট্রাকচার বা বাজার কাঠামো তৈরি করবে। এটি হাউসে ২৯৪-১৩৪ ভোটে পাস হয়েছে এবং এখন সিনেটের পথে। আইনটি স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করবে কোন ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সিকে পণ্য বা কমোডিটি এবং কোনটিকে সিকিউরিটি হিসেবে গণ্য করা হবে।
এর মাধ্যমে স্ক্যাম বা প্রতারণা প্রকল্পের ঝুঁকি হ্রাস পাবে এবং গ্রাহকরা আরো নিরাপদে বিনিয়োগ করতে পারবেন। দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বিশেষ করে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এবং কমোডিটি ফিউচারস ট্রেডিং কমিশনের (সিএফটিসি) মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল যে, কোন সংস্থা কোন ক্রিপ্টো সম্পদের দেখভাল করবে। এই আইন সেই জটিলতাও নিরসন করতে সাহায্য করবে।
তৃতীয় বিল : সিবিডিসির বিরুদ্ধে অবস্থান
তৃতীয় বিলটি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা সিবিডিসি চালুর বিরোধিতা করে। হাউসে এটি ২১৯-২১০ ভোটে পাস হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, ফেডারেল রিজার্ভ ডিজিটাল ডলার চালু করতে পারবে না। বাইডেন প্রশাসনের সময় ফেডারেল রিজার্ভ সিবিডিসি চালুর পরিকল্পনা করলেও ট্রাম্প প্রশাসন এখন সেই পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে।
এই পদক্ষেপ সরকারের দ্বারা নাগরিকদের আর্থিক কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণের আশঙ্কার প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ট্রাম্প নিজেই অতীতে বলেছিলেন, ‘আমি কখনই কেন্দ্রীয় ডিজিটাল মুদ্রা চালুর পক্ষে না, কারণ এটা নাগরিকদের স্বাধীনতার জন্য হুমকি।’
এই তিনটি বিল পাসের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টো বাজারেও। বিটকয়েনের দর বেড়ে এক লাখ ২০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা সর্বকালের রেকর্ড। ইথেরিয়ামও চার হাজার ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। পাশাপাশি সোলানা, ডজকয়েন, অ্যাভালাঞ্চের মতো মূলধারার কয়েনগুলোতেও উল্লেখযোগ্য দাম বৃদ্ধির দেখা মিলেছে।
ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে বিটকয়েনকে স্বীকৃতি দেবেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ক্রিপ্টো-বান্ধব দেশ হিসেবে গড়ে তুলবেন। তার এই পদক্ষেপগুলো সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষারই প্রতিফলন। তিনি নিজেও বিভিন্ন সময়ে তার এনএফটি সংগ্রহ, বিটকয়েন হোল্ডিংস ও ট্রাম্প কয়েনের মাধ্যমে ক্রিপ্টো নিয়ে সরব থেকেছেন। যদিও অনেকেই ট্রাম্প-কয়েনকে এক অর্থে প্রতারণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বিশ্ব নেতৃত্বের পথে যুক্তরাষ্ট্র?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিলগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নেবে না, বরং দেশটিকে বৈশ্বিক ক্রিপ্টো অর্থনীতির নেতৃত্বেও নিয়ে যাবে। মেটা, গুগল, পেপ্যাল, ব্ল্যাকরকের মতো মার্কিন করপোরেট জায়ান্টরাও এই খাতে সক্রিয় হওয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল অর্থনৈতিক কাঠামোর সূচনা ঘটছে।