Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

ইস্পাতশিল্পের ভবিষ্যৎ কি ঝুঁকিতে

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১৬:০১

ইস্পাতশিল্পের ভবিষ্যৎ কি ঝুঁকিতে

প্রতীকী ছাবি

বিশ্বজুড়ে ইস্পাতশিল্প এমন এক গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়েছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। একদিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন, অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে এই শিল্প এখন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৭ সালের মধ্যে বিশ্বে অব্যবহৃত অতিরিক্ত ইস্পাতের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৭২১ মিলিয়ন টনে, যা এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করছে। এর সহজ সমাধান হতে পারত উৎপাদন কমিয়ে আনা। কিন্তু সমস্যাটি এখানেই জটিল হয়ে উঠেছে। কোনো দেশই এককভাবে উৎপাদন কমাতে রাজি নয়, কারণ ইস্পাতকে প্রতিটি দেশ তার অর্থনৈতিক শক্তি এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে।

ঐতিহাসিকভাবেই ইস্পাত নির্মাণ অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতীক। আধুনিক জীবনের প্রতিটি কাঠামো আকাশচুম্বী ভবন থেকে শুরু করে রাস্তা, গাড়ি, ফ্রিজ, ইলেকট্রনিকস এমনকি সামরিক সরঞ্জাম যেমন ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান-এসবই ইস্পাতের ওপর নির্ভরশীল। আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো এলিজাবেথ ব্রাউয়ের মতে, ‘কোনো দেশই সবকিছু নিজে তৈরি করতে পারে না। কিন্তু যে পণ্যগুলোর ওপর যেকোনো পরিস্থিতিতে নিশ্চিত দখল চান, ইস্পাত তার মধ্যে অন্যতম।’ ইউরোপে এই বাস্তবতা আরো প্রকট। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর মহাদেশটির নিরাপত্তার প্রধান রক্ষাকবচ নয়, এই বোধোদয় ইস্পাতের নিরাপত্তাগত গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এই কারণেই দেশটির শেষ দুটি ব্লাস্ট ফার্নেস চালু রাখতে সরকার জরুরি আইন পাস করতেও দ্বিধা করেনি।

এদিকে গত দশকে চীনের সস্তা ইস্পাত বিশ্ববাজারের সমীকরণ পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। দেশটির বিশাল কারখানাগুলো, যা আংশিকভাবে সরকারি ভর্তুকিতে নির্মিত এবং ইউরোপের মতো কঠোর পরিবেশগত বিধি-নিষেধ থেকে মুক্ত, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বিপুল পরিমাণে ইস্পাত উৎপাদন করছে। এই সস্তা ইস্পাত বিশ্ববাজারে ছেয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কেজিপ্রতি হিসাবে ইস্পাতের দাম এখন বোতলজাত পানির চেয়েও কম। এর ফল হয়েছে মারাত্মক। বিশ্বজুড়ে ইস্পাত কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমেছে, বেড়েছে কর্মী ছাঁটাই। 

চীন থেকে সস্তা ইস্পাতের আমদানি ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডাম্পিংবিরোধী বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না। চীনের ইস্পাত এখনো বিভিন্ন পথে বাজারে প্রবেশ করছে, যার ফলে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো ঐতিহ্যবাহী রপ্তানিকারক দেশগুলোও নতুন ক্রেতা খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। ইউরোপিয়ান স্টিল অ্যাসোসিয়েশনের কমিউনিকেশনস প্রধান লুসিয়া সালি এই পরিস্থিতিকে ‘ডোমিনো এফেক্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই সংকটের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর বাণিজ্যনীতি। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন উৎপাদকদের সুরক্ষা দিতে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর প্রায় সব দেশ থেকে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। ফলে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় ইস্পাত রপ্তানি যেমন কমবে, তেমনি অন্যান্য দেশও তাদের পণ্য বিক্রির জন্য ইউরোপের বাজারকে আরো বেশি লক্ষ্যবস্তু বানাবে। এতে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ আরো বাড়বে।

যুক্তরাজ্য ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্ক থেকে ছাড় পেলেও দেশটির পুরোনো কারখানাগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। স্কানথর্পের ব্রিটিশ স্টিল কমপ্লেক্সটিকে সম্প্রতি সরকার অধিগ্রহণ করেছে, কারণ এর চীনা মালিক জিংই গ্রুপ প্রতিদিন প্রায় ৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার ক্ষতির কারণে কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। অন্যদিকে ওয়েলসে টাটা স্টিলের পোর্ট ট্যালবট কারখানাকে সবুজ প্রযুক্তিতে রূপান্তরের জন্য সরকার ৫০০ মিলিয়ন পাউন্ড অনুদান দিয়েছে। একই চিত্র নেদারল্যান্ডসেও। আমস্টারডামের কাছে টাটা স্টিলের আইমুইডেন কারখানাটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ১১০০ ফুটবল মাঠের সমান বিশাল এই কারখানাটিও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণের অভিযোগে ডাচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা টাটার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাচ্ছে। কোম্পানিটি ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য হাইড্রোজেন ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে এবং এর জন্য সরকারের সঙ্গে ভর্তুকি নিয়ে আলোচনা করছে। তবে এই রূপান্তরে বিলিয়ন ডলার খরচ হবে এবং এতে অনেক সময় লাগবে। 

বর্তমানে সবুজ প্রযুক্তিতে ইস্পাত উৎপাদনের খরচ প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি। এর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ৫০ শতাংশ শুল্ক আইমুইডেন প্ল্যান্টের জন্য একটি বড় ধাক্কা। টাটা জানিয়েছে, তাদের বিক্রির ১২ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এই শুল্কের কারণে তাদের ইস্পাত হয়তো মার্কিন গ্রাহকদের কাছে ‘অতিরিক্ত ব্যয়বহুল’ হয়ে উঠবে।

বিশ্ব ইস্পাতশিল্প আজ এক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে, যেখানে শুধু উৎপাদন কমানোই নয়, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ন্যায্য বাণিজ্যনীতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর রূপান্তরই হতে পারে উত্তরণের একমাত্র পথ। নচেৎ, চীনের সস্তা উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় বিশ্বব্যাপী সংকটে পড়বে ভবিষ্যতের ইস্পাতশিল্প।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫