Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

দুর্লভ ধাতুর সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবে ইউরোপ?

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:৫৩

দুর্লভ ধাতুর সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবে ইউরোপ?

প্রতীকী ছাবি

আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ব অর্থনীতিতে অদৃশ্য, কিন্তু অপরিহার্য এক উপাদানের নাম ‘রেয়ার আর্থ মেটাল’ বা দুর্লভ ধাতু। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, উইন্ড টারবাইন কিংবা হাসপাতালের এমআরআই স্ক্যানারের মতো প্রযুক্তি সচল রাখতে প্রয়োজন হয় ১৭টি দুর্লভ ধাতুর। আর এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর সরবরাহ চেইন নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে কৌশলগত প্রতিযোগিতা চলছে, তার অন্যতম এক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ফ্রান্সের পশ্চিম উপকূলের মনোরম শহর লা রশেল। প্রায় ৮০ বছর ধরে এখানকার একটি শিল্প-কারখানা নীরবে এই দুর্লভ ধাতু উৎপাদন করে আসছে, যা আজ ইউরোপের শিল্প সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে উঠছে।

আটলান্টিক মহাসাগরের ঝলমলে তীরের পাশে অবস্থিত এই রাসায়নিক প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাটি চালাচ্ছে বেলজিয়াম শিল্পপ্রতিষ্ঠান সলভে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে রেয়ার আর্থ ধাতুর গুরুত্ব বাড়তে থাকায় ইউরোপের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে কারখানাটির সম্প্রসারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এই সম্প্রসারণের পেছনে রয়েছে এক বিরাট ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা। বর্তমানে বিশ্বে ব্যবহৃত রেয়ার আর্থের প্রায় ৭০ শতাংশ খনন এবং ৯০ শতাংশ পরিশোধন হয় চীনে। বহু বছর ধরে চীনা সরকারের দৃঢ় সমর্থনের ফলে দেশটি এই খাতে একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করেছে। ইউরোপসহ বিশ্বের বহু অঞ্চল এই গুরুত্বপূর্ণ ধাতুগুলোর জন্য চীনের ওপর প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল, যা একটি বড় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত।

করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের মতো ঘটনাগুলো বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনের ভঙ্গুরতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যখন কোনো প্রয়োজনীয় উপাদানের জন্য প্রায় শতভাগ একটি নির্দিষ্ট দেশের ওপর নির্ভর করতে হয়, তখন ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বা যেকোনো সংকট মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এই উপলব্ধি থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত বছর ‘ক্রিটিক্যাল র’ ম্যাটেরিয়ালস অ্যাক্ট’ কার্যকর করেছে। এর মূল লক্ষ্য হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে ইউনিয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালগুলোর খনন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমদানির ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা।

এই লক্ষ্য পূরণে লা রশেলের সলভে কারখানাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইউরোপে বর্তমানে মাত্র দুটি রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে। একটি এস্তোনিয়ায় এবং অন্যটি ফ্রান্সে। তবে সলভের এই প্ল্যান্টটিই একমাত্র কারখানা, যা চীনের বাইরে ১৭ ধরনের রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষমতা রাখে। কারখানাটি এখন তার ব্যবসার মডেলেও পরিবর্তন আনছে। আগে যেখানে এর মূল মনোযোগ ছিল গাড়ির ক্যাটালিটিক কনভার্টারের জন্য রেয়ার আর্থ সরবরাহ করা, সেখানে এখন বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, উন্নত ইলেকট্রনিকস ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামে ব্যবহৃত শক্তিশালী চুম্বকের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই রূপান্তরকে সমর্থন জোগাতে ফরাসি সরকার কারখানাটিকে প্রায় ২০ মিলিয়ন ইউরো ট্যাক্স ক্রেডিট প্রদান করছে।

তবে শুধু নতুন কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাতকরণই নয়, ইউরোপের অভ্যন্তরে থাকা পুরোনো পণ্য থেকে রেয়ার আর্থ পুনর্ব্যবহার করাও সলভের কৌশলের একটি বড় অংশ। সলভের সিইও ফিলিপ কেরেনের মতে, ব্যবহৃত মোটর ও অন্যান্য বাতিল হওয়া যন্ত্রপাতি থেকে রিসাইক্লিং করেই ইউরোপের চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। যেহেতু চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে, তাই রিসাইক্লিং যথেষ্ট হবে না। ব্রাজিল, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো থেকে নতুন কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজন হবে। ইউরোপে এখনো কার্যকর কোনো রেয়ার আর্থ খনি নেই; নরওয়ে ও সুইডেনের কিছু প্রকল্প আশাব্যঞ্জক হলেও সেগুলো উৎপাদনে যেতে অন্তত এক দশক সময় লাগবে।

লা রশেলের এই কারখানার ভেতরে দুর্লভ ধাতুগুলোকে ব্যবহারযোগ্য সূক্ষ্ম গুঁড়ায় পরিণত করার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল ও গোপনীয়। প্রায় পনেরোশটি ধাপে এই রূপান্তর সম্পন্ন হয় এবং কারখানার বিশেষায়িত জ্ঞান প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে সুরক্ষিত রাখতে এর ভেতরে প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। 

রেয়ার আর্থ মেটাল নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের লক্ষ্য পরিষ্কার। তারা চায় চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে। তবে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো বলছে, চীনের রাষ্ট্র সমর্থিত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে তাদের আরো বেশি সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি পরিবেশগত চ্যালেঞ্জও একটি বড় বিষয়। চীন অতীতে পরিবেশদূষণের ঝুঁকি নিয়েই খনন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে এগিয়ে গেছে। সলভে দাবি করে, তারা দূষণ ছাড়াই দায়িত্বশীলভাবে এটি করতে সক্ষম, তবে তার জন্য খরচ বেশি হবে। অর্থাৎ সুরক্ষিত ও পরিবেশবান্ধব সাপ্লাই চেইনের জন্য ইউরোপের বাজারকে কিছুটা বাড়তি মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এই মূল্য নির্ধারণ এবং গাড়ি নির্মাতা ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ক্রয়ের প্রতিশ্রুতিই লা রশেলের মতো কারখানার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, যা প্রকারান্তরে ইউরোপের প্রযুক্তিগত সার্বভৌমত্বের ভবিষ্যৎও বটে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫