Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

২৫টি বোয়িং কি বিমানের বোঝা হবে?

Icon

ইশতিয়াক হুসাইন

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৫, ১২:১১

২৫টি বোয়িং কি বিমানের বোঝা হবে?

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে থাকা বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরেই উড়োজাহাজ সংকটে ভুগছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। পুরনো উড়োজাহাজগুলো ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়ছে, নতুন রুট চালু বা ফ্লাইট সংখ্যা বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এই বাস্তবতায় বোয়িং কেনার বিষয়টিকে কেউ কেউ সময়োপযোগী এবং কৌশলগতভাবে প্রয়োজনীয় মনে করছেন।

তারা বলছেন, এটি জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জন্য বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। আবার কেউ আশঙ্কা করছেন, এটি অযাচিত বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এ বিষয়ে বিমানের মতামত উপেক্ষা করা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানের নিজস্ব পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া এমন বড় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে ভবিষ্যতে এটি আর্থিক ঝুঁকি হয়ে উঠতে পারে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশি পণ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ থেকে রেহাই পেতে ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বোয়িং কেনার সিদ্ধান্ত জানানোর পর বাংলাদেশ শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বোয়িং কেনার সিদ্ধান্ত যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে গত ২৭ জুলাই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আরোপিত শুল্ক কমাতে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ কেনা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির একটি চুক্তি সম্পন্ন করেছে।

সচিবের এই বক্তব্যের পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বিমান চলাচল খাত সংশ্লিষ্টরা বিমানকে না জানিয়ে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ কেনার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

কেউ কেউ বলছেন, এটি রাষ্ট্রায়ত্ব বিমানের ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিমানের সিদ্ধান্তের আগেই সরকারের ২৫টি বোয়িং কেনার সিদ্ধান্তকে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া বলে অভিহিত করেছেন বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম।    

ঋণের বোঝা নাকি সম্ভাবনা

বিমানের বহরে বর্তমানে ১৯টি উড়োজাহাজ রয়েছে। উড়োজাহাজের অভাবে বিমান চাহিদা থাকা সত্বেও কয়েকটি রুটে ফ্লাইট সংখ্যা বাড়াতে পারছে না। তেমনি নতুন নতুন রুটও চালু করতে পারছে না উড়োজাহাজ স্বল্পতায়। এ অবস্থায় বিমানের জন্য নতুন উড়োজাহাজ জরুরিভাবে প্রয়োজন। বিগত সরকারের আমলে বোয়িং ও এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কেনা নিয়ে আলোচনা চলেছিল। শেষ পর্যন্ত বোয়িং প্রস্তাবে না গিয়ে বিমান এয়ারবাস কেনার প্রক্রিয়া অনেকটাই এগিয়েছিল। ৮ আগস্ট অন্তবর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর হঠাৎ করেই ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এটি নিয়ে সরকারের সঙ্গে কয়েক দফায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি হলেও কোনো ফলাফল আসেনি। পরবর্তীতে সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ ও গম আমদানির একটি চুক্তি করার পর শুল্ক কমাতে সক্ষম হয়।

এ প্রসঙ্গে বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “২৫টি নয় বিমানের জন্য ৫০টি উড়োজাহাজ হলে আরও ভালো হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সরকারের চাপিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। বাণিজ্যিক এয়ারলাইন্স হিসেবে স্বাধীনভাবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।”

“৫০টি উড়োজাহাজের মূল্য পরিশোধ করার সক্ষমতা রয়েছে বিমানের। আমি যতদূর জেনেছি, বিমান গেল অর্থ বছরে ৯৩৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে (অনিরীক্ষিত)। সুতরাং বিমানের আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আর এ কারণে একে ঋণের বোঝা বলাও সমীচীন নয়,” বলেন তিনি।  

নজরুল ইসলাম বলেন, “প্রতিবেশি ভারতের এয়ার ইন্ডিয়া ১০০ উড়োজাহাজ অর্ডার দিয়েছে। প্রতিযোগী এয়ারলাইন্স এমিরেটস, কাতার ও সিঙ্গাপুর শতশত উড়োজাহাজ অর্ডার দিচ্ছে। তাই বেশি বেশি উড়োজাহাজের অর্ডারকে সম্ভাবনা হিসেবেই দেখি। এটি মোটেই ঋণের বোঝা নয়।”

নাম না প্রকাশের শর্তে বিমানের মার্কেটিং বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, “৫৪ বছরে সরকারের কোনো ধরনের সহায়তা ছাড়াই বিমান উড়োজাহাজ কিনেছে। তেবে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপই বিমানকে কখনওই বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে দেয়নি।” ‍

কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “ব্র্যান্ড নিউ উড়োজাহাজ কেনার আর্থিক সক্ষমতা বিমানের রয়েছে। তবে আর্থিক সক্ষমতা থাকলেই হবে না, এজন্য সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।”

বিমান কয়টি উড়োজাহাজ কিনতে কাজ করছে  

সরকার ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করলেও রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স ১৪টি উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করছে।

বিমানের একাধিক সূত্র জানায়, নতুন উড়োজাহাজ কিনতে ইতোমধ্যে বোয়িং ও এয়ারবাস কোম্পানি ১৪টি করে মোট ২৮টি এয়ারক্র্যাফটের প্রস্তাব দাখিল করেছে। দুটি প্রস্তাবই বিমানের নিয়মানুসারে টেকনো ফিন্যান্সিয়াল কমিটির কাছে মূল্যায়নের জন্য কার্যক্রম চলমান রয়েছে। টেকনো ফিন্যান্সিয়াল কমিটির মূল্যায়ন কার্যক্রম বিমান পরিচালনা পর্ষদের কাছে পাঠানো হবে। সেক্ষেত্রে উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেবে বিমানের পরিচালনা পর্ষদ।

বিষয়টি নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের আগে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. সাফিকুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, নতুন উড়োজাহাজ কেনার বিষয়ে এরই মধ্যে বোয়িং ও এয়ারবাসের দেওয়া প্রস্তাব টেকনিক্যাল ফাইন্সিয়াল কমিটির মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয়েছে। ওই কমিটির মূল্যায়নের পর বিষয়টি বিমানের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠানো হবে।

সরকারের ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার বিষয়ে মন্তব্য জানতে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) রওশন কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাম্প্রতিক দেশকালকে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নতুন উড়োজাহাজ কেনার আর্থিক সক্ষমতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স যে বিপুল সংখ্যক বোয়িং কিনেছে তার প্রতিটি ইনস্টলমেন্ট (কিস্তি) বিমান সময়মতো দিয়েছে। সুতরাং বিমানের সক্ষমতা রয়েছে।”

বিমানের বর্তমান বহরের হাল

২০১১ সালে বিমানের বহরে বোয়িং যুক্ত হয় দুটি ৭৭৭ ৩০০ ইআর মডেলের উড়োজাহাজ। সেই হিসেবে এই দুটি উড়োজাহাজের বয়স প্রায় ১৫ বছর হয়ে গিয়েছে। এই দুটি উড়োজাহাজ আর কয়েক বছর পর বহর থেকে বিদায় করতে হবে। ২০১৪ সালে যুক্ত আরো দুটি ৭৭৭ ৩০০ ইআর। এ দুটির বয়সও ১০ বছরের বেশি। এ দুটিও সর্বোচ্চ ৮/৯ বছর সেবা দিতে পারবে।

২০১৫ সালের বিমানে যুক্ত হয় দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০। এ দুটির বয়স ১০ বছরের বেশি। ২০১৮ সালের দুটি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ও ২০১৯ সালে একটি ড্রিমলাইনার বহরে যুক্ত হয়। ২০১৯ সালে যুক্ত হয় দুটি বোয়িং ৭৫৭-৮০০ উড়োজাহাজ। আর ২০১৯ সালে চতুর্থ ড্রিমলাইনার যুক্ত হয়। 

২০২০ সালে বিমানে যুক্ত হয় প্রথম ড্যাশ-৮ ৪০০ উড়োজাহাজ। আর ২০২১ সালে যুক্ত হয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় ড্যাশ-৮ ৪০০।

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ ও বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “বিমানের বহরের উড়োজাহাজ পুরনো হওয়ায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে।”

আরেক বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, “এমনিতেই উড়োজাহাজ সংকটে রয়েছে বিমান। এরপর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ পুরাতন হয়ে যাবে। ফলে তখন সংকট তীব্র আকার ধারণ করবে। এখনো যদি বিমান উড়োজাহাজ অর্ডার দেয় পাঁচ বছরের আগে একটি উড়োজাহাজও বহরে যুক্ত হবে না। প্রতিষ্ঠানটির উচিত ছিল বহরের উড়োজাহাজ পর্যালোচনা করে আরও আগে নতুন উড়োজাহাজ সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া।”

লিজের উড়োজাহাজই কি শেষ ভরসা?

বিমান ২৫টি গন্তব্যে সেবা দিচ্ছে, যার মধ্যে ১৭টি আন্তর্জাতিক গন্তব্য। ভবিষ্যতে আরও ৪৩টি দেশে গন্তব্য সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের পরিষেবা চুক্তি রয়েছে। ওইসব আন্তর্জাতিক রুটে পরিষেবা চালু করতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একাধিক ওয়াইড বডি উড়োজাহাজ কেনা প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বের ১৬টি শহরে ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তাদের সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।

তাছাড়া হজের মৌসুমে উড়োজাহাজের সংকটের কারণে বিভিন্ন রুটের ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে দিতে হয়। হজের ফ্লাইট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে এমনকি কোনো কোনো রুট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়। এই সময় নিয়মিত রুটের ফ্লাইটের যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। গেল হজ মৌসুমেও এভাবেই জোড়াতালি দিয়ে ফ্লাইট চালিয়েছে বিমান।

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, “নতুন উড়োজাহাজ কেনার বিষয়ে বিমানকে অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল। কারণ বিমান যদি এখনো ব্র্যান্ড নিউ উড়োজাহাজের জন্য অর্ডার দেয় তাহলে তা পেতে কমপক্ষে ৫ বছর লাগবে। আর এই সময়ে চলমান সংকট কাটাতে লিজে উড়োজাহাজ নেওয়অর বিকল্প নেই।”

তিনি আরও বলেন, “লিজের উড়োজাহাজ পাওয়া নিয়েও দূরুহ। কারণ সব দেশেই উড়োজাাহজের চাহিদা বেড়েছে। আর বাংলাদেশে বর্তমানে ১৫ বছরের বেশি পুরাতন উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া যাবে না, এটিও উড়োজাহাজ পেতে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।”

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. সাফিকুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দুইটি বোয়িংয়ের লিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে ফেরত দিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রুটে ক্যাপাসিটির ঘাটতি হবে। এই ঘাটতি পূরণে তারা আরও দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। আগামী দুই মাসের মধ্যে এগুলো বহরে যুক্ত হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫