
প্রতীকী ছবি
গত তিন বছর ধরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নামের জাদুকরী প্রযুক্তি সিলিকন ভ্যালি থেকে ওয়াল স্ট্রিট পর্যন্ত সবাইকে সম্মোহিত করে রেখেছিল। বিনিয়োগকারীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন, প্রযুক্তিবিদরা একে মানবজাতির ভবিষ্যৎ বলে আখ্যা দিচ্ছিলেন, আর সাধারণ মানুষ মুগ্ধ চোখে দেখছিল চ্যাটজিপিটির মতো সব মনোহর উদ্ভাবন। মনে হচ্ছিল, এ যেন এক নতুন স্বর্ণযুগের রথ, যার চাকা কেবল সামনের দিকেই গড়াবে।
কিন্তু হঠাৎ করেই সেই উৎসবের সুরে যেন তাল কেটে গেছে। ২০২৫ সালের আগস্ট মাসকে হয়তো ভবিষ্যতে ‘এআইয়ের শীতনিদ্রার’ শুরু বলে চিহ্নিত করা হবে। রাতারাতি না হলেও ইন্ডাস্ট্রির কিছু বড় হোঁচট এখন বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী আর সাধারণ গ্রাহকের মনে সন্দেহের বীজ বুনে দিয়েছে। যে মুগ্ধতা ছিল, তার জায়গায় এখন দেখা দিয়েছে সংশয়।
এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে বেশ কিছু অশনিসংকেত। কিছুদিন আগেও যে মেটা (ফেসবুকের মূল কোম্পানি) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে ১০০ মিলিয়ন ডলার সাইনিং বোনাস দিচ্ছিল, তারাই এখন কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, তারা তাদের এআই বিভাগকে ছোট করার কথাও ভাবছে।
আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনদাতা, ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যান নিজেই এখন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ‘বুদবুদ’ বা ‘বাবল’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। যিনি এতদিন ধরে এআইয়ের সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন ফেরি করেছেন, তার মুখেই এমন কথা বিনিয়োগকারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট।
এরপর আসা যাক পণ্যের কথায়। ওপেনএআই ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের পরবর্তী সংস্করণ ‘চ্যাটজিপিটি-৫’ হবে পিএইচডি স্তরের জ্ঞানী এবং সবকিছু বদলে দেবে। কিন্তু বাস্তবে এটি মুখ থুবড়ে পড়েছে, প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ। অন্যদিকে এনভিডিয়ার সমর্থনে চলা ক্লাউড কম্পিউটিং কোম্পানি ‘কোরউইভ’ মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে নিজেদের শেয়ারের প্রায় ৪০ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে। এই পতন যেন বাজারের অস্থিরতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এসেছে গবেষণার জগৎ থেকে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) গবেষকরা এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, কোম্পানিগুলো যে ৯৫ শতাংশ জেনারেটিভ এআই প্রোগ্রাম চালু করেছে, সেগুলো তাদের মূল উদ্দেশ্য ‘আয় বৃদ্ধি’ করতেই ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যেই আবার অ্যানথ্রপিক ও ওপেনএআইয়ের মতো কোম্পানিগুলো নিজেদের পণ্য প্রায় বিনামূল্যে মার্কিন সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চুক্তি করছে। অথচ এই কোম্পানিগুলো নিজেরাই নগদ অর্থের সংকটে ভুগছে এবং লাভজনক হওয়ার কোনো সুস্পষ্ট পথ দেখাতে পারছে না। এই পদক্ষেপকে অনেকেই মরিয়া প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
এসব ঘটনার সম্মিলিত প্রভাবে শেয়ারবাজারে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। বিনিয়োগকারীরা এখন ‘ডিজাস্টার পুটস’ কেনার জন্য দৌড়াচ্ছেন। এটি এমন এক ধরনের বিকল্প, যা বাজারের পতনের সময় বিমা হিসেবে কাজ করে। ব্লুমবার্গের তথ্য মতে, বিনিয়োগকারীরা শুধু ছোটখাটো পতনের জন্য নয়, বরং ১৯৯০-এর দশকের ডটকম বাস্টের মতো বড় ধরনের ধসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আগের সপ্তাহে এনভিডিয়া, মাইক্রোসফট ও প্যালান্টির মতো প্রযুক্তি স্টক, যারা পুরো বাজারকে একাই টেনে তুলছিল, তাদেরও পতন হয়েছে। অবশ্য এর পেছনে শুধু এআইয়ের দুঃসংবাদই নয়, শুল্ক, খুচরা বাজারের মিশ্র আয় এবং মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভে প্রেসিডেন্টের পছন্দের লোক বসানোর চেষ্টার মতো বিষয়গুলোও কাজ করছে।
তবে সবাই যে হতাশ, তা নয়। ইউএস ব্যাংক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের সিনিয়র ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজি ডিরেক্টর রব হাওর্থের মতে, এই পতন হয়তো ‘একটি সাময়িক বিরতি’, যা বিনিয়োগকারীদের নতুন করে ভাবার এবং তাদের প্রযুক্তি ডলার কোথায় বিনিয়োগ করবে তা পুনর্বিন্যাস করার সুযোগ দেবে। হয়তো তাই। কিন্তু বাজারের উত্থান-পতনই এআইয়ের প্রভাব মাপার একমাত্র মানদণ্ড নয়। প্রযুক্তি লেখক এবং ‘বেটার অফলাইন’ পডকাস্টের হোস্ট এড জিট্রন বলেন, ‘এই বুদবুদ ফাটা কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনার ফল হবে না, বরং এটি হবে এমন একটি প্রযুক্তির বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে জনমত পরিবর্তনের ফসল।’ তিনি আরো যোগ করেন, ‘তিন বছর পেরিয়ে গেছে, এখন প্রমাণ করার সময় এসেছে যে এই সবকিছুর আদৌ কোনো মূল্য ছিল কি না।’
জিট্রনের কথাই হয়তো শেষ কথা। তিন বছরের স্বপ্ন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আর আকাশছোঁয়া প্রতিশ্রুতির পর এখন সবাই ফলের জন্য অপেক্ষা করছে। যদি সেই ফল না আসে, তবে হয়তো সত্যিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই রঙিন বেলুনটি চুপসে যেতে আর বেশি দেরি নেই। যে জাদুর ঘোর সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তা হয়তো ভাঙার সময় হয়ে এসেছে।