৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখবে কে?

জান্নাতুল ফেরদৌসী
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:০২

শেয়ারবাজারের দর দেখছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।
তলানিতে থাকা পুঁজিবাজারে যখন একটু একটু করে লেনদেন বাড়ছিল, বিনিয়োগকারীরা হারানো পুঁজির কিছুটা ফেরত পাওয়ার আশায় ছিলেন, ঠিক তখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ব্যাংক বহির্ভূত ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) অবসায়নের সিদ্ধান্তে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
শেয়ারদর ক্রমাগত কমছে, আরও বেশি লোকসান হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকে কম দামে বিক্রির অর্ডার বসালেও ক্রেতা মিলছে না।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে লুটপাট ও অনিয়মের শিকার হওয়া এ ৯ প্রতিষ্ঠান হলো— এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। এর মধ্যে কেবল অভিভা ফাইন্যান্স তালিকাভুক্ত নয়।
এগুলো আগে থেকেই ১০ টাকার অভিহিত মূল্যের নিচে লেনদেন হচ্ছিল, নতুন ঘোষণায় তা আরও কমে গেছে। রবিবার লেনদেনে বিআইএফসি ছিল ৪ টাকা ৫০ পয়সা, এফএএস ফাইন্যান্স ১ টাকা ৭০ পয়সা, প্রিমিয়ার লিজিং ১ টাকা ৯০ পয়সা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ২ টাকা এবং জিএসপি ফাইন্যান্স ৩ টাকা ৬০ পয়সা দরে লেনদেন হয়েছে। ফারইস্ট ফাইন্যান্স নেমেছে ১ টাকা ৯০ পয়সায় এবং পিপলস লিজিং ১ টাকা ৪০ পয়সায়। গত ৯ কর্মদিবসে এ শেয়ারগুলোর দর গড়ে ৩০ শতাংশের বেশি কমেছে।
কেন এই ধস?— কারণ বিনিয়োগকারীরা জানেন না, কোম্পানি বন্ধ হলে তাদের অর্থ ফেরত মিলবে কিনা। বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার কথা বললেও শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি।
বছর কয়েক আগে বেক্সিমকো সিনথেটিক তালিকাচ্যুত হওয়ার সময় সম্পদমূল্য হিসাব করে বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার না বাংলাদেশ ব্যাংক, না বিএসইসি, না ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ—কেউ কোনো স্পষ্ট বক্তব্য দিচ্ছে না।
বিএসইসির একজন কর্মকর্তা সাম্প্রতিক দেশকালকে জানান, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে, তবে কোনো জবাব আসেনি। তিনি বলেন, সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের দায় নেয় না, তবে আলোচনা চলছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “একটা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেলে আসলে আর করার কিছু থাকে না। বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি মেনে নিতেই হবে।” তাঁর মতে, প্রাথমিকভাবে বিএসইসিরই এ খাত তদারকি করা উচিত ছিল, কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান আইনকানুন মানেনি, তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী ছিল।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির চেয়ারম্যান ও বাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য শিক্ষা। তিনি মনে করেন, অনেকেই কোম্পানির আর্থিক অবস্থা যাচাই না করে গুজবের ওপর ভিত্তি করে শেয়ার কিনেছেন। “ছোট বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে বিক্রি করছেন, অথচ এ থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে,” মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫টি এনবিএফআই আছে—৩টি সরকারি, ৩২টি বেসরকারি। মোট শাখা ৩০৮টির মধ্যে ১৭৩ ঢাকায়, ৪৭ চট্টগ্রামে এবং বাকি ১০৮ সারা দেশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের শেষে এনবিএফআই খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা, যার ৫২ শতাংশই এই ৯ প্রতিষ্ঠানের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমানত নিরাপদে ফেরত দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব। তবে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব কে নেবে— সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এ কুদ্দুস চৌধুরী বলেন, “এই খাতের সমস্যা ১৫ বছর আগে শুরু হয়েছিল, অপেশাদার পরিচালকদের কারণেই।” তাঁর মতে, একটি প্রতিষ্ঠানের পতন গোটা খাতকে প্রভাবিত করে, তাই বিনিয়োগের আগে আর্থিক শিক্ষার প্রয়োজন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে, যেসব এনবিএফআই উন্নতি করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেগুলো বন্ধ করতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান সময়মতো আমানত ফেরত দিতে পারছে না; খেলাপি ঋণ ও লোকসান দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে।