বেড়েছে দারিদ্র্যের হার
খাবার কিনতেই খরচের অর্ধেকের বেশি ব্যয়

শোয়েব রহমান
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:০১

প্রতীকী ছবি
দেশে প্রতি চারজনের একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবন অতিবাহিত করছে। গ্রাম ও শহরে আয় এবং ধনী ও দরিদ্রের আয়ের পার্থক্য বেড়েছে। ১৮ শতাংশ পরিবারে কোনো সংকট দেখা দিলে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেভেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ তথ্যগুলো উঠে এসেছে।
২০২০ সালের আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ক্রমে কমে আসছিল; কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি অর্থনীতিতে আঘাত হানে। ফলে মূল্যস্ফীতি, চাকরি হারানো ও অর্থনীতির ধীরগতি দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়। করোনার পর বিশ্ব অর্থনীতি যখন উত্তরণের পর্যায়ে ছিল, তখন শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশেও এ প্রবণতা দেখা দেয়; যার প্রভাব এখনো দেখা যাচ্ছে।
এপ্রিলে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। সে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। উল্টো আরো ৩০ লাখ মানুষ অতি দারিদ্র্য হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২২.৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলেও আশঙ্কা করে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু পিআরসির গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মে মাসেই বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশে! অথচ ২০২২ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বিগত সরকারের আমলে হওয়া দুর্নীতি, লুটপাটের কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
২৫ আগস্ট রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডি মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে পিপিআরসি। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। পিপিআরসির গবেষণায় বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আর বিবিএসের জরিপটি করা হয়েছে ১৪ হাজার ৪০০ পরিবারের ওপর। পিপিআরসি জরিপ করে আট হাজার ৬৭ পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ জনের ওপর। ২০২২ সালের বিবিএসের জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে-এই তিন বছরে অতি বা চরম দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে। ২০২২ সালের অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৫.৬ শতাংশ, ২০২৫ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৯.৩৫ শতাংশে।
কত মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যয় ধরে দারিদ্র্য পরিমাপ করে বিবিএস। একজন মানুষের দৈনিক গড়ে দুই হাজার ১২২ ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার কিনতে এবং অন্যান্য খরচ মেটাতে যত টাকা প্রয়োজন হয়, সেই টাকা আয় করতে না পারলেই ওই ব্যক্তিকে দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। তবে খাবারের দাম এলাকাভেদে ভিন্ন হয়।
বিবিএসের জনশুমারি অনুসারে, ২০২২ সালে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ এবং পরিবারের সংখ্যা ছিল চার কোটি ১০ লাখ। জনসংখ্যার ওই হিসাবটি বিবেচনায় আনলে দেশে এখন কমপক্ষে পৌনে পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।
গ্রামে আয় বেড়েছে, কমেছে শহরে
শহরের পরিবারগুলোর আয় কমলেও গ্রামের পরিবারগুলোর গড় আয় আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। একটি পরিবারের গড় আয় বর্তমানে ২৯ হাজার ২০৫ টাকা এবং ব্যয় ২৭ হাজার ১৬২ টাকা। সার্বিকভাবে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসে গড় আয় ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। আর ব্যয় ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা। অর্থাৎ মানুষের গড় সঞ্চয় মাসে মাত্র ৭০ টাকা।
গত তিন বছরের ব্যবধানে শহরে বসবাসরত পরিবারগুলোর মাসিক আয় কমেছে, তবে বেড়েছে খরচ। বর্তমানে শহরের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা এবং ব্যয় ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। ২০২২ সালে শহরের একটি পরিবারের মাসে গড় আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা।
ধনী ও দরিদ্র্যের আয়বৈষম্য
পিপিআরসির জরিপে উঠে এসেছে, আয়ের দিক থেকে সবচেয়ে নিচে অবস্থান করা ১০ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় মাত্র আট হাজার ৪৭৭ টাকা। এর বিপরীতে শীর্ষ ১০ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় এক লাখ ৯ হাজার ৩৯০ টাকা। অর্থাৎ সমাজের ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয়বৈষম্য প্রকট।
মোট খরচের অর্ধেকের বেশি হয় খাবারে
গবেষণায় দেখা যায়, তুলনামূলক দরিদ্র পরিবারগুলো আয়ের চেয়ে বেশি খরচ করছে। মধ্যবিত্তের চিত্রও একই, তারাও আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করছে। আর এই ব্যয়ের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে খাদ্যে। একটি পরিবারের মাসের মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যায় খাবার কেনায়। শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যয়ও বাড়ছে দ্রুত। খরচ সামাল দিতে অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন, করতে হচ্ছে ধারদেনা। ৪০ শতাংশ পরিবারের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ।
অনেকের নেই পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুসারে, যিনি সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা কাজ করেন তাকে কর্মজীবী হিসেবে ধরা হয়। পিপিআরসির গবেষণায় দেখা যায়, এই মানুষের বড় একটি অংশের পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান নেই। এসব কর্মজীবীর প্রায় চারজনের মধ্যে একজন (৩৮ শতাংশ) পূর্ণ সময় (সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা) কাজ করছেন না। পছন্দ অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না বলেই তারা কাজ করছেন না। শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার আরো কম। কর্মক্ষম বয়সের নারীদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ (২৬ শতাংশ) কর্মক্ষেত্রে যুক্ত।
অন্যদিকে কর্মজীবীদের প্রায় অর্ধেকই স্বনিয়োজিত। অর্থাৎ তারা ছোট ব্যবসা, দোকান, ফুটপাতে পণ্য বিক্রি ইত্যাদি অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। এ ধরনের কাজে আয় অনিশ্চিত ও সামাজিক সুরক্ষা সীমিত। ফলে এই শ্রেণির মানুষ যেকোনো সংকটে আবার দারিদ্র্যের দিকে ফিরে যেতে পারেন।
বড় ঝুঁকি চিহ্নিত
গবেষণায় পাঁচটি বড় ঝুঁকির বিষয়টি আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমত, দীর্ঘমেয়াদি রোগের বোঝা বেড়েছে, যা এখন অর্ধেকের বেশি পরিবারকে আক্রান্ত করছে। দেশের ৫১ শতাংশ পরিবারে অন্তত একজন বা এর বেশি সংখ্যায় উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত। হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণে পরিবারগুলোকে চিকিৎসার পেছনে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে, যা আবার তাদের ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নারীপ্রধান পরিবারগুলো একাধিক দিক থেকে বঞ্চনার শিকার। তৃতীয়ত, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ঋণের পরিমাণ তাদের সঞ্চয়ের দ্বিগুণের বেশি। চতুর্থত, খাদ্য অনিরাপত্তা বেড়েছে, সবচেয়ে দরিদ্র ১২ শতাংশ পরিবারকে খাবারের তালিকা ছোট করতে হয়েছে, এমনকি ৯ শতাংশ পরিবারকে অন্তত এক দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। পঞ্চমত, মৌলিক সেবা ব্যবস্থার স্থবিরতা রয়েছে, যেখানে এক-তৃতীয়াংশ পরিবার এখনো স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
টিকে থাকার উপায়
এসব পরিস্থিতির মধ্যেও টিকে থাকার অন্তত চারটি উপায় ধরেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। এগুলো হলো প্রবাস আয়, ২১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিশাল স্থানীয় ভোক্তা বাজার, ডিজিটাল-ব্যবস্থার প্রতি অভ্যস্ততা এবং ভোক্তার পরিবর্তিত পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়া।
এমন বাস্তবতায় তিনি তিন ধরনের সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, অনিয়মিত আয় ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে স্বল্পমেয়াদি জরুরি সহায়তা দিতে হবে, বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী রোগের ব্যয় নতুন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। মধ্য মেয়াদে কর্মসংস্থান বাড়াতে সম্ভাবনাময় খাতগুলোর জন্য কৌশলগত সহায়তা প্যাকেজ প্রণয়নে একটি সরকারি-বেসরকারি যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার। দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির পরিকল্পনায় জনমুখী দৃষ্টি রাখতে হবে।
সার্বিকভাবে গবেষণা বলছে, দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্রের পেছনে যেসব অসংগতির চাপ কাজ করছে, তা শুধুই পরিসংখ্যানে নয়, মানুষের বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে। এসব সংকট মোকাবেলায় জনমুখী নীতিনির্ধারণ এখন সময়ের দাবি।