Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

মার্কিন শ্রমবাজারে বেড়েছে মন্দার শঙ্কা

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:১১

মার্কিন শ্রমবাজারে বেড়েছে মন্দার শঙ্কা

প্রতীকী ছবি

বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির আকাশে জমছে কালো মেঘ। যে শক্তিশালী শ্রমবাজার এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছিল, তা এখন স্পষ্টতই মন্থর হয়ে পড়ছে। আগস্ট মাসের চাকরির পরিসংখ্যান মার্কিন অর্থনীতির দুর্বলতাকে আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, যা অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ বিনিয়োগকারী-সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। প্রশ্ন উঠছে, এটি কি বড় কোনো অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস, নাকি কেবলই একটি সাময়িক ছন্দপতন?

মার্কিন শ্রম দপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্ট মাসে নিয়োগকর্তারা মাত্র ২২ হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি করেছে। এই সংখ্যাটি হতাশাজনকই শুধু নয়, এটি একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে চরম দ্বিধায় ভুগছে। যে অর্থনীতিতে প্রতি মাসে লাখ লাখ চাকরি তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল, সেখানে এই সামান্য বৃদ্ধি প্রায় স্থবিরতারই নামান্তর। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেকারত্বের হারও ৪.২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে উদ্বেগটা শুধু এক মাসের তথ্য নিয়ে নয়, বরং এটি একটি চলমান দুর্বলতার চিত্র তুলে ধরেছে। এর আগেই শ্রম দপ্তর জানিয়েছিল, মে ও জুন মাসের চাকরির সংখ্যা প্রাথমিকভাবে যা ধারণা করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক কম ছিল। ৫ সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে সেই চিত্রটি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে-নতুন হিসাব অনুযায়ী, জুনে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো নতুন চাকরি তো তৈরি হয়ইনি, উল্টো দেশটিতে চাকরি কমেছে, যা ২০২০ সালের মহামারির ভয়াল দিনগুলোর পর প্রথমবার ঘটল। ফিচ রেটিংসের যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক অর্থনৈতিক গবেষণা প্রধান ওলু সোনোলা পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-‘এক মাস আগে শ্রমবাজারে যে সতর্ক ঘণ্টা বেজেছিল, তা এবার আরো জোরে বাজল।’ তার কথায় স্পষ্ট, এই দুর্বলতা আকস্মিক নয়, বরং এটি একটি ক্রমবর্ধমান ও উদ্বেগজনক প্রবণতা।

অর্থনীতির এই দুঃসংবাদে বিনিয়োগকারীরা কিন্তু অদ্ভুতভাবে এক ধরনের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। এর কারণ হলো দুর্বল শ্রমবাজারের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড), সুদের হার কমাতে বাধ্য হবে বলে তারা মনে করছেন। সাধারণত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমায়, যা ব্যবসা ও বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেওয়া সহজ করে তোলে এবং বাজারে অর্থের জোগান বাড়ায়। এই প্রত্যাশায় ওই রিপোর্ট প্রকাশের পর শেয়ারবাজার সামান্য ঊর্ধ্বমুখী হয়ে খোলে। বিনিয়োগকারীরা আপাতত অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত না হয়ে স্বল্পমেয়াদি লাভের দিকেই মনোযোগ দিচ্ছেন। 

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এই মন্দার দায় কে নেবে, তা নিয়ে ওয়াশিংটনে শুরু হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক টানাপড়েন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ করেছেন, তাকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল দেখানোর জন্য চাকরির সংখ্যায় কারচুপি করা হয়েছে এবং এর জেরে তিনি শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রধানকে বরখাস্ত করেছেন। তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা বলছেন, সমস্যার মূল প্রেসিডেন্টের নিজের নীতিতেই নিহিত। অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছিলেন, ট্রাম্পের আরোপ করা বাণিজ্য শুল্ক এবং কঠোর অভিবাসন নীতি ব্যবসার খরচ ও অনিশ্চয়তা বাড়াবে, যা শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির ক্ষতি করবে। যেমনটা সোনোলা মন্তব্য করেছেন, ‘টানা চার মাস ধরে উৎপাদন খাতে চাকরি কমছে। শুল্কনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা এখানে বড় ভূমিকা রাখছে না-এ কথা বলা কঠিন।’ অন্যদিকে হোয়াইট হাউস এই পরিস্থিতির জন্য ফেডারেল রিজার্ভ ও তার চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলকে সরাসরি দায়ী করছে। তাদের মতে, ফেড সুদের হার কমাতে অনেক দেরি করেছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট এক বিবৃতিতে পাওয়েলকে কটাক্ষ করে বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতিহাসের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক প্রবৃদ্ধিমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। কিন্তু এই কর্মসূচি বারবার আটকে যাচ্ছে জেরোম ‘খুব দেরি’ পাওয়েলের নির্বুদ্ধিতায়।”

সব মিলিয়ে মার্কিন অর্থনীতি এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে চাকরির বাজার ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে, জুলাই মাসে চাকরির শূন্যপদ ২০২১ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে এবং মহামারির পর এই প্রথম চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা উপলব্ধ চাকরির চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। অন্যদিকে মজুরি বৃদ্ধির হার (৩.৭ শতাংশ) এখনো কিছুটা শক্তিশালী, যা ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতাকে কিছুটা হলেও ধরে রেখেছে এবং অর্থনীতিকে পুরোপুরি ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করছে। হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কেভিন হ্যাসেট আগস্টের চাকরির তথ্যকে ‘হতাশাজনক’ বলে স্বীকার করলেও আশা প্রকাশ করেছেন, ভবিষ্যতে সংশোধিত পরিসংখ্যানে হয়তো ভালো চিত্র দেখা যাবে। তবে আপাতত সবাই তাকিয়ে আছে ফেডারেল রিজার্ভের দিকে। সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত প্রায় নিশ্চিত, কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই পদক্ষেপ কি মার্কিন অর্থনীতিকে মন্দার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে, নাকি এটি আরো বড় কোনো সংকটের প্রাথমিক লক্ষণ?

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫