Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

‘শান্তি’ পানি থেকে বঞ্চিত নাগরিকরা, ‘মাথাব্যথা নেই’ ওয়াসার

Icon

আবুল বাসার সাজ্জাদ

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৫৯

‘শান্তি’ পানি থেকে বঞ্চিত নাগরিকরা, ‘মাথাব্যথা নেই’ ওয়াসার

২০০৬ সালে ওয়াসা বাজারে ছেড়েছে বোতলজাত ‘শান্তি’ পানি। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা রাজধানীতে দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন করে আসছে ‘শান্তি’ নামে বিশুদ্ধ বোতলজাত পানি, যার দাম বাজারের অন্যান্য পানির তুলনায় অনেক কম। কিন্তু এই ‘শান্তি’ পানি সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না, মিলছে না দোকানে। ফলে তারা বাজারের দামে বাধ্য হয়ে অন্য পানি কিনছেন। কিন্তু এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই ওয়াসার।

রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকার বাসিন্দা কাওসার হোসেন এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “দোকান থেকে উচ্চমূল্যে বোতলজাত পানি কিনে খেতে হয়। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়াসা বোতলজাত পানি উৎপাদন করছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু তাদের সেই ‘শান্তি’ পানি আমরা পাই না। রাজধানীর কোনো দোকানে পাওয়া যায় না। আমাদের জন্য ওয়াসার এসব নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। তারা ‘শান্তি’ নিয়ে ব্যাপক শান্তিতেই আছে।”

শুধু কাওসার নন। বোতলজাত পানি কিনে খাওয়া শান্তি পানির বিষয়ে অবগত এমন সব ক্রেতার অভিযোগ, প্রায় দুই দশক ধরে এই পানি উৎপাদন হলেও তাদের উপকারে আসছে না। কারণ খুচরা কোনো দোকানে বা হোটেলে এই পানি বিক্রি হয় না। তাই সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।

দিনদিন দেশের বাজারে বোতলজাত পানির দাম বেড়েই চলছে। ক্রেতারা বাজার থেকে উচ্চমূল্যে বোতলজাত পানি কিনতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিনছেন। বছরদুয়েক আগে বিভিন্ন কোম্পানির বোতলজাত ৫০০ মিলিগ্রাম পানির দাম ছিল ১৫ টাকার ভেতরে। তবে এখন সব কোম্পানির পানিই ২০ টাকা বা তারও ওপরে বিক্রি হচ্ছে।

পানির বাজার যেন অস্থির না হয়, সেজন্য ২০০৬ সালে ওয়াসা বাজারে ছেড়েছে বোতলজাত ‘শান্তি’ পানি। তবে এই পানির উৎপাদন থাকলেও দেখা মেলে না বাজারে। দেশের অন্যান্য কোম্পানিগুলোর চেয়ে এই পানি তুলনামূলক সস্তায় মেলে।

ঢাকা ওয়াসার বোতলজাত পানির ব্র্যান্ড ‘শান্তি’ প্রায় এক দশক ধরে চালু থাকলেও বাজারে তার অবস্থান খুব একটা দৃশ্যমান নয়। ওয়াসার মিরপুর প্ল্যান্টে প্রতিঘণ্টায় বিশাল পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন করার সক্ষমতা থাকলেও তা খুচরা বাজারে পৌঁছাতে পারছে না। ফলে বাজারে পরিচিতি পাচ্ছে না এই সরকারি উদ্যোগ।

প্ল্যান্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা যথেষ্ট হলেও বাস্তবে তা কমে আসে নানা কারণে। উৎপাদিত পানির বড় অংশই বিভিন্ন অফিস, বিশেষ প্রতিষ্ঠান কিংবা কিছু ত্রাণ কার্যক্রমে বরাদ্দ হয়। খুচরা বাজারে ওয়াসার নিজস্ব পরিবেশক থাকলেও সংখ্যা সীমিত এবং নেটওয়ার্ক দুর্বল। এছাড়াও খুচরা দোকানদারদের মুনাফা কম হওয়ায় তারা নেন না। ফলে দোকানগুলোতে সহজে পাওয়া যায় না ‘শান্তি’।

লালমাটিয়া এলাকার বাসিন্দা সেলিম হাওলাদার বলেন, “ওয়াসা নামমাত্র এই বোতলজাত পানি উৎপাদন করছে। তাদের এই পানি কোনো দোকানে পাবেন না। যদি কম মূল্যের এই বিশুদ্ধ পানি কোথাও নাইই পাই, তবে আমাদের উপকারটা হবে কীভাবে?”

ওয়াসার কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, শান্তি মূলত বাণিজ্যিক ব্র্যান্ড হিসেবে নয়, সামাজিক উদ্যোগ হিসেবে বাজারে এসেছে। এর মাধ্যমে পানি বাজারে ভারসাম্য রক্ষা ও দাম নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যেই উৎপাদন করা হচ্ছে।

তবে খুচরা বাজারে উপস্থিতি বাড়াতে হলে নীতি ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন দরকার বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কম মুনাফা হওয়ায় তারা শান্তি পানি দোকানে রাখেন না। আর বেসরকারি পানি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচিতি বেশি থাকায় সেগুলো বেশি চলে।

মোহাম্মদপুরের টাউনহল এলাকায় মুদি দোকান শাহবাজপুর জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা সাদ্দাম হোসেন জানান, শান্তি পানি বাজারে চলে না। আর পানির গাড়িও তো আসে না। গাড়ি দিয়ে অন্যান্য পানি দিয়ে যায়। কিন্তু এই পানি আসে না।

তিনি সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “মানুষ এই নামের পানি চিনে না তো। যদি দোকানে আনাও হয়, তাহলে বিক্রি হবে কম। তবে দাম কম আছে যেহেতু, মানুষের জানাশোনা হলে প্রচুর চলবে। এটার ব্যাপারে তো ওয়াসার প্রচার প্রচারণা নাই। তাদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য কতটুকু সেটা হলো ব্যাপার।”

রাজধানীর চা ও মুদি দোকানসহ বিভিন্ন দোকানে নানা কোম্পানির বোতলজাত পানি পাওয়া যায়। তবে মোহাম্মদপুর, আসাদগেট, ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার ঘুরে কোনো দোকানে শান্তি পানি পাওয়া যায়নি।

বিশুদ্ধ, সাশ্রয়ী, তবু অচেনা

কারওয়ান বাজারে আবু বকরের চায়ের দোকান থেকে কিনলে কোম্পানির ৫০০ মিলি এক বোতল পানি কিনেছেন মো. মারুফ।

তিনি কখনও ওয়াসার বোতলজাত ‘শান্তি’ পানি খেয়েছেন কি না জানতে চাইলে বলেন, “শান্তি পানি আবার কোনটা? কখনও নামও শুনিনি।”

এসময় চা দোকানি আবু বকর মারুফকে বলেন, “ওয়াসার পানি। একবার আনছিলাম, মানুষ খায় কম। আমারও লাভ কম হয়। আর ওয়াসার পানি দেইখাও অনেকে কিনতে চায় না। কিন্তু দাম কম আছে। আমাদের লাভ কম হইলেও মানুষ কমে খাইতে পারে। গরিব মানুষ খায় বেশি। তারা নামটাম বুঝে কম।”

পাইকারি মূল্যে শান্তির পানি অন্য পানির তুলনায় একটু বেশি দামি হওয়ার কারণে অনেক বিক্রেতা এই পানি রাখতে চান না বলে জানালেন এই দোকানি।

স্বপ্ন সুপারশপে বিভিন্ন কোম্পানির বোতলজাত পানি দেখা গেলেও শান্তি পানি নেই। সুপারশপ স্বপ্নের কাঁঠালবাগান এলাকার বক্সকালভার্ট রোড ব্রাঞ্চের সেকেন্ড ম্যানেজার শাখাওয়াত হোসেন বলেন, “শান্তি পানি তো চিনিই না। কখনও নাম শুনিনি।”

উৎপাদন আছে, বাজারজাত নেই

শান্তি পানির কারওয়ান বাজার ব্রাঞ্চের বিক্রয় প্রতিনিধি মাসুদ আলম জানালেন, ২৫০ মিলি শান্তি পানির বোতলের মূল্য ১০ টাকা দেওয়া থাকলেও বিক্রি করেন ৭ টাকা, আর ৫০০ মিলির মূল্য দেওয়া আছে ১৫ টাকা। তবে বিক্রি করেন ১০ টাকায়। ১ লিটারের মূল্য রয়েছে ২০ টাকা, তবে বিক্রি করেন ১৫ টাকায়, ২ লিটারের বোতলের মূল্য ৩০ টাকা, আর বিক্রি ২২ থেকে ২৫ টাকা। আর সর্বশেষ ৫ লিটারের বোতলের মূল্য রয়েছে ৬৫ টাকা, তবে বিক্রি হয় ৪৫ টাকায়।

তিনি জানালেন, ২০০৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই শান্তি পানি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিক্রিতে নড়চড় নেই। আর ব্যাপকহারে বাণিজ্যিক চিন্তা নেই বলেই খুচরাতে বিক্রি হয় না বলে ভাষ্য তার।

তিনি আরও বলেন, “কিছুক্ষণ আগে এক লোক কিনলে ব্র্যান্ডের ৫০০ মিলিগ্রামের এক কেস (২৪টি) নিয়ে আসছে, বলল ২৮০ টাকা দিয়ে কিনেছে। প্রতিটির পিস পড়েছে সাড়ে ১১ টাকা করে। আর বিক্রি করবে ২০ টাকায়। এখানে তার লাভ একেকটাতে সাড়ে ৮ টাকা। আর আমাদের এখানে ১৫ টাকা মূল্য। সে কিনতে পারবে ৯ টাকায়। এখানে তার লাভ কম। তাই কেনে না।”

তিনি জানালেন, ওয়াসার বোতলজাত শান্তি পানির ডিলার রয়েছে লালমাটিয়া ও ফকিরাপুল পানির টাংকির সঙ্গে, যাত্রাবাড়ি আইডিয়াল স্কুলের পাশে, মিরপুর বাংলা কলেজের পাশে ও উত্তরাসহ আরও অনেক জায়গায়।

বাংলামোটর এলাকার বেসরকারি কোম্পানির এক কর্মকর্তা আরাফাত আলম বলেন, “বেশ বিশুদ্ধ ‘শান্তি’ পানি। এ জন্য ওয়াসার ডিলারদের থেকে কেস কিনে খাই। কিন্তু সমস্যা হলো ডিলারদের ছাড়া এই পানি কিনতে পারি না। তখন অন্য পানি কিনে খেতে হয়।”

শান্তি পানির মূল শাখা মিরপুরের প্রধান বিক্রয় প্রতিনিধি আতিকুর রহমান দেশকাল নিউজকে বলেন, “শান্তি পানি শুধু ঢাকা কেন্দ্রিকই বেচাকেনা চলে। এর বাইরে এর কোনো ডিলার নেই। আর খুচরা বিক্রি হয় না। পাইকারিতেই শুধু বিক্রি চলে।”

তার কাছে দৈনিক কেমন বিক্রি হয় জানতে চাইলে তিনি তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরামশ দেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে।

পরে ওয়াসার মহাপরিচালকের টেলিফোন নাম্বার ফোন দেওয়া হলে কথা বলেন মহাপরিচালকের একজন সহকারী। তিনি জানালেন শান্তি পানি কর্তৃপক্ষ আলাদা, যারা দায়িত্বে আছে তারা কথা বলবে।

‘শান্তি’ পানি উৎপাদন প্লান্টের প্লান্ট ম্যানেজার মো. আজিমুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি বলেন, “দেশে যাতে পানি নিয়ে কেউ একচেটিয়া ব্যবসা করতে না পারে, যখন তখন দাম না বাড়াতে পাড়ে, তাই সরকারিভাবে শান্তি পানি উৎপাদন ও বিক্রি করা হয়। এটি মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশে নয়। তাই কোথাও এই পানি বিপণন করা হয় না।”

এছাড়া তার কাছে আরও কিছু বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নতুন এসেছেন আবার দায়িত্ব থেকে চলে যেতে হবে। তাই কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি ওয়াসার প্রধান কার্যালয় থেকে তথ্য জানার পরামর্শ দেন। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫