
ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স, যা একটি পরোক্ষ কর। ছবি: সংগৃহীত
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একই হলেও সরকারকে কর প্রদানে ব্যবসায়ীকে দুই ধরনের হিসাব রাখতে হয়। একই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জেনারেল অ্যাকাউন্টসকে এনবিআরের আয়কর বিভাগ গ্রহণ করলেও ভ্যাট বিভাগ আলাদা হিসাবপত্র রাখতে বাধ্য করে।
ওই ভ্যাট বিভাগই আবার নিরীক্ষার সময় কোম্পানির নিরীক্ষিত হিসাবই গ্রহণ করে, তখন আর ভ্যাট আইন অনুসারে খাতাপত্রে রাখা হিসাবকে আমলে নেওয়া হয় না।
দুই ধরনের হিসাব রাখার কারণে হিসাবে গরমিলের সুযোগ তৈরি হয় এবং ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়। এতে বাড়ে ব্যবসার খরচও।
এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও নিরীক্ষকদের দাবি, একই এনবিআরের অধীনে আয়কর ব্যবস্থায় আলাদা কোনো হিসাবপত্র রাখতে হয় না। জেনারেল অ্যাকাউন্টসের ভিত্তিতে আয়কর নির্ণয় করা হয়।
ভ্যাট নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাটের জন্য আলাদা হিসাবপত্র রাখতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের খরচ বাড়ে, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে দ্রব্যমূল্যের ওপর পড়ে।
তারা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ যুগেও ভ্যাট চালানপত্র হাতে লিখে জারি করার বিধান বলবৎ রয়েছে। এসব কারণে অনেকে হিসাবে কারসাজি করতে বাধ্য হয়। এতে ভ্যাট ফাঁকি ঘটে। যদি আয়করের মতো জেনারেল অ্যাকাউন্টসের ভিত্তিতে ভ্যাট হিসাব করা হতো, তাহলে এ সমস্যাগুলো থাকত না।
আয়কর ও ভ্যাটের জন্য একই ধরনের হিসাব ব্যবস্থা থাকার বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “এবারের বাজেটেই এটি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। ভ্যাট আইনে এটি দীর্ঘ সময় ধরে রয়ে গেছে। ভ্যাটের জন্য এত হিসাব রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।”
এনবিআরের সাবেক ভ্যাট কর্মকর্তাদের দাবি, মূল্য সংযোজন কর বা মূসক চালানপত্র হাতে লিখে জারি করা এবং ক্রয়-বিক্রয় হিসাবপত্র ইআরপি সফটওয়্যারে রাখা বাস্তবসম্মত নয়।
বড় ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত।
বসুমতি গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম নবী দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “এনবিআরের নীতিগত কারণে ভ্যাট ব্যবস্থাকে জটিল করা হয়েছে। ভ্যাট আমরা যেমন ভালো বুঝি না, যারা আদায় করেন তারাও পরিষ্কার নয়—পরস্পরবিরোধী হয়ে গেছে। সহজ হতো যদি অন্য ধরনের হিসাব থেকে বেরিয়ে এসে জেনারেল অ্যাকাউন্টসের মাধ্যমে ভ্যাট আদায় করা হয়।”
ব্যবসা রেখে এনবিআরের পেছনে বেশি সময় ব্যয় করতে হয় বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “আয়করের মতো সহজ করে ভ্যাট রিটার্ন নিলে সুবিধা হয়।”
“ভ্যাটের কোনো আইন নাই, ভ্যাটের আইন হলো এনবিআর। সব ভুলের মাশুল দিতে হয় ব্যবসায়ীকে, এনবিআর নিজের ভুলেরও কোনো দায় নিতে চায় না। এটা একটা জুলুম।”
ব্যবসার লোকসানকে এনবিআর হিসাবে নিতে চায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “শুধু টার্নওভারের ওপর ভ্যাট নির্ধারণ করে দেয়। ভ্যাটের সুদ রাষ্ট্রপতিও মাফ করতে পারেন না। ভ্যাট অফিসারদের এত ক্ষমতা!”
এনবিআরের কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, “ভ্যাটের জন্য আলাদা হিসাবপত্র রাখার কোনো দরকার নেই। এতে বরং ব্যবসার খরচ ও ব্যয় বাড়ে, হয়রানি বাড়ে। কিন্তু ভ্যাট বা কর ফাঁকি কমে না, বরং বাড়ে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভ্যাট বিশেষজ্ঞ বলেন, “ভ্যাট আইন অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল ক্রয়, সেটি থেকে পণ্য উৎপাদন, অবচয় ও বিক্রয়ের সঠিক হিসাব রাখেন না। ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করেন না, তারা ফাঁকি দিতে চান। সেজন্য এনবিআরও তাদের চেপে ধরে এবং এ ধরনের হিসাব রাখার জন্য বাধ্য করে।
“তবে একটি হিসাবেই আয়কর ও ভ্যাটের সব বিষয় একীভূত করার চিন্তাও চলছে। সেটি হয়ে গেলে হয়তো সমাধান হয়ে যাবে।”
ভ্যাটের হিসাবপত্র রাখতে আলাদা ভ্যাট সফটওয়্যার এনবিআরের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ এবং ঝামেলাপূর্ণ বিষয়।
একটা প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ছাড়াও আরও নানা ধরনের কাজ থাকে। এজন্য যারা বড় প্রতিষ্ঠান, তারা ইআরপি সফটওয়্যার ব্যবহার করে।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় ভ্যাট আইন ও বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠান ইআরপি সফটওয়্যারের মাধ্যমে হিসাবপত্র রাখতে পারবে। তবে ভ্যাট চালানপত্র (মূসক-৬.৩) এখনও ইআরপি সফটওয়্যারে তৈরি করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এনবিআরের সদস্য (মূসক নিরীক্ষা) সৈয়দ মুসফিকুর রহমান দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “আমাদের ভ্যাটের হিসাবটা মাসিক, আর আয়করের জন্য বার্ষিক। তাই মাসিক হিসাবটা প্রয়োজন হয়। আমাদের রেজিস্টারগুলো ঐচ্ছিক। কেউ এসব তথ্য (ভ্যাট রেজিস্টারে বর্ণিত) নিজের মতো তাদের কম্পিউটারে ইআরপি সিস্টেমে ধারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সেটাই বছর শেষে আয়কর বিভাগ ব্যবহার করতে পারে।”
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিষয়গুলো লিমিটেড কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠান তার মতো করে হিসাব রাখে।”
৫ কোটির বেশি টার্নওভারের প্রতিষ্ঠানের জন্য কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে হিসাব রাখা বাধ্যতামূলক হলেও এর সেভাবে প্রয়োগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে একটি উল্লেখযোগ্য করদাতা প্রতিষ্ঠানের অডিট ফার্ম যেসব আর্থিক প্রতিবেদন বানায়, সেগুলো ব্যাংকের জন্য একটা, আর এনবিআরের জন্য আলাদা।
“ব্যাংকেরটায় তাদের বিক্রয় এবং লাভ বেশি দেখানো হয়, যাতে ঋণ পেতে সুবিধা হয়। আমি নিজে এ ধরনের অনেক ফাঁকি উদঘাটন করে অনেক মামলা দিয়েছি।”
এস আলম গ্রুপেরই ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির মামলা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান সাইফুর এনায়েত অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস-এর প্রধান নির্বাহী সাইফুর রহমান বলেন, “ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাবপত্র রাখা হয় কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর অধীনে। কোনো প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগ প্রথমে ক্রয়-বিক্রয়ের জার্নাল প্রস্তুত করে, এরপর লেজার বা খতিয়ান তৈরি হয়, তারপর ট্রায়াল ব্যালান্স এবং সর্বশেষে আর্থিক হিসাব প্রস্তুত করা হয়। এই হিসাব সিএ অডিটর দ্বারা আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা মানদণ্ড অনুযায়ী অডিট করা হয়।”
প্রতিষ্ঠানের সব আয়-ব্যয়, লাভ-ক্ষতি, ক্রয়-বিক্রয় এই হিসাবেই অন্তর্ভুক্ত থাকে—এখানে কোনো কিছুই বাদ যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু ভ্যাটের ক্ষেত্রে আবার আলাদা হিসাবপত্র (যেমন ম্যানুয়াল মূসক বই) রাখতে হয়, যা আসলে দ্বৈত হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করে।”
এতে তথ্য বিকৃতির সুযোগ তৈরি হয় এবং ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, “অথচ একই এনবিআরের অধীনে আয়করের জন্য আলাদা খাতা রাখতে হয় না—জেনারেল অ্যাকাউন্টসের ভিত্তিতেই আয়কর নির্ধারণ হয়। তাহলে ভ্যাটও কেন একই হিসাব থেকে নির্ধারণ করা যাবে না, সেটিই প্রশ্ন।”
অ্যাকনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস-এর পরিচালক মোহাম্মদ মুতাসিম হোসাইন বলেন, “মূসক নিরীক্ষা করা হয় নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর, তাহলে আলাদা করে ভ্যাটের জন্য হিসাব রাখার যৌক্তিকতা কী? আলাদা ক্রয় রেজিস্টার কেন রাখতে হবে?”
এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯৯১ সালে যখন দেশে ভ্যাট চালু করা হয়েছিল, তখন অ্যাকাউন্টস ব্যবস্থা অনেক দুর্বল ছিল। এখন তা অনেক সুশৃঙ্খল হয়েছে। ডকুমেন্টস বা ডাটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালুর পর অ্যাকাউন্টস আরও সংগঠিত হয়েছে।
এখন ভ্যাটের জন্য আলাদা হিসাবের কোনো প্রয়োজন নেই বলে মত দিয়ে তিনি বলেন, “একটা বিক্রয়ের জন্য একটা চালানপত্র হতে হবে, এর একটা ফরম্যাট থাকতে হবে।
“কম্পিউটারে, ল্যাপটপে, মোবাইলে, পয়েন্ট অব সেলসে (পিওএস) যে যেভাবে পারে, এক ফরম্যাটে একটা চালানপত্র জারি করবে। একজনের বিক্রয়, আরেকজনের ক্রয় হবে। এমন হিসাব ব্যবস্থা চালু করা গেলে ভ্যাট ফাঁকি বহুলাংশে কমে যাবে।”