Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

বদলে যাচ্ছে গ্রাম, বদলে যাচ্ছে অর্থনীতি

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:১৪

বদলে যাচ্ছে গ্রাম, বদলে যাচ্ছে অর্থনীতি

জাতীয় জীবনে গ্রামীণ অর্থনীতির গুরুত্ব অসীম। আমাদের দেশ বহু আগে থেকেই গ্রামনির্ভর অর্থনীতির দেশ। নব্বইয়ের দশকে পাঠ্যপুস্তকে লেখা হতো, দেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং জাতীয় অর্থনীতির ৮০ শতাংশ অর্জিত হয় গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই পরিসংখ্যান বদলে গেছে। এখন মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের বাস গ্রামে। বাকি ৪০ শতাংশ শহরে বাস করে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ভেতরে উন্নত অর্থনৈতিক চিন্তার বিকাশ ঘটেছে। 

গ্রামে-শহুরে সুযোগ-সুবিধার অনেকটা পৌঁছে গেছে, তবুও মানুষ এখনো শহরমুখী। সব সংকটের সমাধান শহরে-এমন ধারণা থেকে শহরমুখী মানুষের ঢল ক্রমেই বাড়ছে। তবে এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার রিপোর্টে সে রকম আভাস পাওয়া যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, শহর থেকে গ্রামমুখী মানুষের সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা হলেও বেড়েছে। প্রশ্ন জাগতে পারে, গ্রামের মানুষের শহরমুখী মানুষের সংখ্যা কমার কারণ কী? সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্যের বরাত দিয়ে একটি গণমাধ্যম জানিয়েছে, ‘গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, গ্রামের মানুষ সনাতনী কৃষিকে আর আঁকড়ে ধরে নেই। তারা নন-ফার্মিং অ্যাক্টিভিটিজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। অনেকেই কৃষির পাশাপাশি নানা ক্ষুদ্র উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের অর্থনীতিকে বদলে দিয়েছে। গ্রামে কৃষি ছিল অধিকাংশ মানুষের নির্ভরতা।

৮০ শতাংশ মানুষের কৃষিনির্ভর জীবনের পরিবর্তন ঘটেছে। বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীলতা দিয়েছে। গ্রামের মানুষ এখন শহরের সুবিধা ভোগ করছেন। কালার টিভি, ফ্রিজ, বৈদ্যুতিক বাতি বা এয়ারকুলার এখন গ্রামেও ব্যবহৃত হচ্ছে। মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে বৈশ্বিক উন্নয়নের চিত্র এখন মানুষের নাগালে। বিদেশি বিভিন্ন ফল-ফলাদি সবজি গ্রামে চাষ হচ্ছে। সেগুলো শহরেও চলে যাচ্ছে গ্রামের চাহিদা মিটিয়ে। ফলে লাভবান হচ্ছে কৃষক ও চাষি। 

শুধু কৃষিকাজই নয়, গ্রামের মানুষ এখন বহু ধরনের পেশায় নিজেদের যুক্ত করে জীবন বদলে দিচ্ছে। উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছে গ্রামের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরাও। গ্রাম মানেই এখন আর কৃষিকাজ নয়। নব্বইয়ের দশকেও বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অবস্থা এখনকার মতো অতটা চাঙ্গা ছিল না। তখন শহরের অর্থনীতি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য ছিল। অভাব, দুঃখ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার, অজ্ঞতা, পশ্চাৎমুখী সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের অচলায়তন সৃষ্টি করে রেখেছিল। সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠেছে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রামীণ অর্থনীতি মোড় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। গ্রামীণ জনগণের মধ্যে এখন কৃষির পাশাপাশি ছোট ছোট শিল্প স্থাপনের প্রতি আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে।

স্রেফ কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন নয়, এর পাশাপাশি হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ তাদের ভাগ্যোন্নয়নে পুরোপুরি সচেষ্ট বলা যায়। এখন গ্রামে গেলেই চোখে পড়বে হাঁস-মুরগির খামার, দুগ্ধ উৎপাদনকারী ডেইরি ফার্ম, মৎস্য চাষ প্রকল্পের সব চোখ ধাঁধানো খামার। যেটা খুবই ইতিবাচক। এসব খামারে যারা কাজ করে তারা একসময় পেশায় জেলে, কৃষক, তাঁতি বা কামার-কুমার ছিলেন। এখন তারাই তাদের প্রতিমুহূর্ত নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজে ব্যয় করছেন। মাঠে কৃষিকাজের পাশাপাশি গ্রামের মানুষ পোলট্রি ফার্ম ও ডেইরি ফার্মেও প্রয়োজনীয় সময় দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে উপার্জনের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। ফল-ফলাদির মধ্যে জ্যৈষ্ঠের আম-কাঁঠাল নয়, সারা বছর ফল ফলছে ক্ষেতে-খামারে-রামবুটান, ড্রাগন, পেয়ারা, বাউকুল, স্ট্রবেরি, ফলের মতো বিদেশি ফল চাষ হচ্ছে। মৌসুমি সবজি ছাড়া সারা বছর উৎপাদন করা যায় এমন সবজি চাষ করা হচ্ছে। চাকরির পেছনে না ছুটে গ্রামের তরুণরা এখন চাষাবাদ এবং খামারে আগ্রহী হচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে গ্রামে কৃষক ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত মানুষের অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকায় তাদের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়ছে। 

গ্রামে এখন মানুষের হাতের নাগালে ইন্টারনেট, কম্পিউটার। ফ্রিল্যান্সিং পেশায় ঝুঁকছে গ্রামের তরুণ-তরুণীরা। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে জমির সহজলভ্যতার কারণে উদ্যোক্তাদের অনেকেই এখন শহরের পরিবর্তে গ্রামে তাদের শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে শুরু করেছেন। এতে শিল্প খাতে খরচ কমছে আবার শ্রমিকরা গ্রামের হওয়ায় তারাও লাভবান হচ্ছেন। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি গতিশীল হচ্ছে। 

ধান, পাট ও শাক-সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছেছে। কিন্তু আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির অভাব এবং অপ্রতুল গবেষণা কৃষি উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করছে। গ্রামীণ হস্তশিল্প, কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্পের চাহিদা দেশ ও বিদেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নকশিকাঁথা, মাটির পণ্য এবং বাঁশ-বেতের হস্তশিল্পের চাহিদা বাড়লেও রপ্তানি বাজারে প্রবেশ এখনো সীমিত। 

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত এবং দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। তারা বিদেশে গিয়ে যে টাকা পাঠায় তাতে দেশের অর্থনীতিতে যেমন ভূমিকা রাখে তেমনি গ্রামে অবস্থান করা তাদের পরিবারগুলোরও সংকট মুক্তি ঘটে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠার পেছনে জনশক্তি রপ্তানি খাতের অবদান অসীম । 

গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি নির্ভরতার সঙ্গে শিল্পায়নের দিকে নিয়ে গেলে যে উন্নয়ন ঘটবে তা জাতীয় অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। আমাদের দেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। তাই চাষযোগ্য জমি যাতে নষ্ট না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামে যেসব আবাদযোগ্য জমি আছে, তার বেশির ভাগই এক ফসলি অথবা দুই ফসলি। ফলে অধিকাংশ জমি বছরের বেশির ভাগ সময় অনাবাদি থাকে। পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে এক ফসলি জমিকে দুই ফসলি এবং দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা যেতে পারে। পরিকল্পিতভাবে চাষের আওতায় আনার উদ্যোগ নিলে কৃষি অর্থনীতি আরো জোরালো হবে। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় গ্রামীণ অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে। বদলের এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতির অবকাঠামোও বদলে যাবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫