বিমানবন্দরে আগুনে ওষুধ শিল্পে শতকোটি টাকার ক্ষতি: বিএপিআই
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৩৪
মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ ওষুধ মালিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএপিআইয়ের নেতারা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৪৫ বেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (বিএপিআই)।
এতে ওষুধ শিল্পে শত কোটি টাকার কাঁচামাল, প্যাকেজিং উপকরণ ও জরুরি সরঞ্জাম ভস্মীভূত হয়েছে বলে দাবি সংগঠনটির।
মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ ওষুধ মালিক সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়৷
বিএপিআইয়ের সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “তাৎক্ষণিক সংকট না থাকলেও বড় বিপদ সামনে।”
তিনি বলেন, “আমরা সাধারণত আমদানিকৃত কাঁচামালের দুই থেকে তিন মাসের মজুত রাখি। তাই তাৎক্ষণিকভাবে বাজারে ওষুধের ঘাটতি তৈরি হয়নি। কিন্তু যদি দ্রুত আমদানি প্রক্রিয়া সচল না করা যায়, এক মাসের মধ্যেই উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।”
“আমরা এখন সরকারের সহযোগিতা চাই- যেন ব্যাংকিং সাপোর্ট ও আমদানি প্রক্রিয়া সহজ হয়। বিমানবন্দরের এই অগ্নিকাণ্ড একটি অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়, কিন্তু এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো, উৎপাদন সচল রাখা এবং সাপ্লাই চেইন যেন বন্ধ না হয়।”
ক্ষতির পরিমাণ ও আমদানির চ্যালেঞ্জ
বিএপিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে ৪৫ কোম্পানির সুনির্দিষ্ট ক্ষতির হিসাব ইতোমধ্যেই সংগৃহীত হয়েছে, যা কাঁচামালের সরাসরি ক্ষতি। তবে বাকি কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে পরোক্ষ ক্ষতি ও ভবিষ্যতের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করা হয় চীন, ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে।
এখনও পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত চালানের মূল্যায়ন সম্পূর্ণ হয়নি। বিএপিআইয়ের প্রস্তাব, এই ক্ষতিগ্রস্ত চালানের বিপরীতে কাস্টম ডিউটি, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স, গোডাউন চার্জ ও ডেমারেজ ফি মওকুফ করা হোক। পাশাপাশি কার্গো ভিলেজ সম্পর্কিত কাস্টম হাউস যেন অফিস ছুটির দিনেও আংশিকভাবে খোলা থাকে, যাতে দ্রুত পণ্য রিলিজ সম্ভব হয়।
‘দাম বাড়ানো নয়, উৎপাদন সচলই লক্ষ্য’
বিএপিআইয়ের মহাসচিব মো. জাকির হোসেন বলেন, “এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ যেন বাজারে সংকট তৈরি বা দাম বাড়ানোর কাজে না যায়। দাম বাড়ানো আমাদের লক্ষ্য নয়। আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য, দেশের জীবনরক্ষাকারী ওষুধের সরবরাহ যেন বিঘ্নিত না হয়।”
তিনি আরও বলেন, “বিএপিআই ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে একাধিক প্রস্তাব পাঠিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে- অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের চার্জ ও জরিমানা মওকুফ; ক্ষতিগ্রস্ত কনসাইনমেন্টের দ্রুত রিলিজের জন্য কাস্টমস ও বিমান কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা; প্রয়োজনীয় আমদানি পুনরায় শুরু করতে এলসি ও পেমেন্ট প্রক্রিয়া সহজীকরণ ইত্যাদি।”
‘সরকারি ব্যর্থতার ফলে এমন ক্ষতি’
সংবাদ সম্মেলনে রেনেটা লিমিটেডের প্রতিনিধি কায়সার আহমেদ অগ্নিকাণ্ডকে প্রশাসনিক ব্যর্থতা উল্লেখ করে বলেন, “কাস্টমের দায়িত্ব ছিল আমাদের পণ্য রক্ষা করা, কিন্তু তারা তা পারেনি। মৌলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল না। এটা বর্তমান সরকারের পাশাপাশি পূর্ববর্তী সরকারেরও ব্যর্থতা। আগের সরকার দেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর দাবি করে আর বর্তমান সরকার মধ্যম আয়ের দেশ, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি।”
তিনি বলেন, “আমাদের প্রধান উদ্বেগ ক্ষতিপূরণ নয়, বরং সরবরাহ চেইন সচল রাখা। একটি ম্যাটেরিয়াল অনুপস্থিত থাকলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। আমরা আগুনের পরপরই নতুন এলসি খুলেছি, এখন সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যেন নতুন চালান আসায় কোনো বাধা না হয়।”
এয়ারলাইনসকে গ্রিন সিগন্যাল দাবি
বিএপিআইয়ের কোষাধ্যক্ষ ও হেলথার ফার্মাসিউটিক্যালসের সিইও হালিমুজ্জামান বলেন, “কুলচেইন প্রোডাক্ট সংরক্ষণের জন্য যে স্টোর ছিল, সেটি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে এখন নতুন কুলচেইন পণ্য আসলেও কোথায় রাখা হবে, তা অনিশ্চিত। ফরওয়ার্ডিং কোম্পানিগুলোও এতে ঝুঁকি দেখছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই, দ্রুত সব এয়ারলাইনসকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হোক, যেন নতুন চালানগুলো আটকে না থাকে। পাশাপাশি কাস্টমস যেন বিন লক না করে, কারণ বিন লক হয়ে গেলে আমরা নতুন এলসি খুলতে পারব না।”
শিল্পের অবদান ও আশঙ্কা
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ পূরণ করে এবং ১৬০ বেশি দেশে রপ্তানি হয়। এ খাত থেকে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে বলে বিএপিআইয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
বিএপিআইয়ের মতে, সময়মতো সরকারি সহায়তা না পেলে এই ধারাবাহিক সাফল্য ব্যাহত হতে পারে।
সংগঠনটির প্রস্তাব- ডিজিডিএ, কাস্টমস, নারকোটিকস, এনবিআর ও বিমান কর্তৃপক্ষকে নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি যৌথ সভা আহ্বান করে সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান করতে হবে।
