Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

রুপির নজিরবিহীন পতনে অর্থনীতির গভীর সংকটে ভারত

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩০

রুপির নজিরবিহীন পতনে অর্থনীতির গভীর সংকটে ভারত

ভারতের অর্থনীতি এক নজিরবিহীন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপি তার ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। রুপির এই পতনের তাৎক্ষণিক কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের এইচ-ওয়ানবি ভিসা ফি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। ভারতের বিলিয়ন ডলারের আইটি শিল্প মূলত মার্কিন ক্লায়েন্টদের ওপর নির্ভরশীল এবং এর ব্যাবসায়িক মডেলের একটি বড় অংশ হলো ভারতীয় কর্মীদের স্বল্প মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে কাজ করানো। ভিসা ফি বাড়ানোর ফলে এই মডেলটি এখন বড় ঝুঁকির মুখে। টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস, ইনফোসিস ও উইপ্রোর মতো সংস্থাগুলোর পরিচালন ব্যয় বাড়বে, যা তাদের মুনাফায় সরাসরি প্রভাব ফেলবে। বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা, যারা ভারতীয় শেয়ারবাজারে, বিশেষ করে আইটি সেক্টরে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করে, তারা এই মুনাফা কমার আশঙ্কায় দ্রুত শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যাচ্ছে। এর প্রমাণ মেলে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ২০২৫ সালেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় ইক্যুইটি বাজার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ তুলে নিয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ পুঁজি প্রত্যাহারের ফলে ডলারের চাহিদা বেড়েছে এবং রুপির ওপর অবমূল্যায়নের চাপ তীব্রতর হয়েছে।

এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে ভারতীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপানো ৫০ শতাংশ শুল্ক, যা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এই শুল্ক ভারতের রপ্তানিনির্ভর শিল্পের (যেমন-পোশাক, হস্তশিল্প ও কৃষি পণ্য) জন্য একটি বড় ধাক্কা। যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় রপ্তানির অন্যতম প্রধান বাজার হওয়ায় এই শুল্ক ভারতের রপ্তানি আয়কে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যা দেশের বাণিজ্য ঘাটতিকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ার অর্থ হলো, আমদানির জন্য ভারতকে আগের চেয়ে বেশি ডলার খরচ করতে হবে, যা রুপির মানকে আরো দুর্বল করে দেবে। অর্থাৎ একদিকে যেমন আইটি পরিষেবা থেকে ডলার আয় কমার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তেমনই অন্যদিকে পণ্য রপ্তানি থেকেও ডলারের প্রবাহ কমে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

এই জটিল পরিস্থিতিতে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি রুপির পতন রোধে কোনো নির্দিষ্ট স্তর রক্ষার চেষ্টা করছে না, বরং একটি নিয়ন্ত্রিত অবমূল্যায়নের পথে হাঁটছে। আরবিআইয়ের মূল লক্ষ্য হলো, রুপির পতন যেন আকস্মিক এবং বিশৃঙ্খল না হয়, যা বাজারে আতঙ্ক তৈরি করতে পারে। এর জন্য তারা মাঝে মাঝে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বাজারে ডলার বিক্রি করে সাময়িক ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছে। তবে আরবিআইয়ের হাতও বাঁধা। কারণ অতিরিক্ত ডলার বিক্রি করলে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এএনজেড ব্যাংকের মুদ্রা কৌশলবিদ ধীরাজ নিম বলেছেন, ২০২৬-২৭ অর্থবর্ষে মূল্যস্ফীতি ৪-৪.৫ শতাংশের মধ্যে থাকলে রুপির এই নিয়ন্ত্রিত পতন হয়তো ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি যদি এর চেয়ে বাড়ে, বিশেষ করে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

রুপির এই অবমূল্যায়নের প্রভাব শুধু শেয়ার বাজার বা বড় বড় কোম্পানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর আঁচ পড়বে সাধারণ মানুষের জীবনেও। যেহেতু ভারত তার প্রয়োজনীয় অপরিশোধিত তেলের ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি করে, রুপির পতনের অর্থ হলো পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়বে। ফলে পরিবহন খরচ বাড়বে এবং খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়কে আরো কঠিন করে তুলবে। বিদেশে অধ্যয়নরত ভারতীয় শিক্ষার্থীদের খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। যদিও প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য এটি একটি আপাত সুখবর, কারণ তারা এখন দেশে টাকা পাঠালে আগের চেয়ে বেশি রুপি পাবেন। বিষয়টি সাময়িকভাবে তাদের পরিবারকে সাহায্য করলেও দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয়দের জন্য কাজের সুযোগ কমে গেলে সামগ্রিক রেমিট্যান্সের প্রবাহ হ্রাস পেতে পারে।

ভারতীয় অর্থনীতি এখন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। মার্কিন সংরক্ষণবাদী নীতি এবং অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতার সম্মিলিত প্রভাবে রুপি ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ভারতকে শুধু মুদ্রার অবমূল্যায়ন রোধ করলেই চলবে না, বরং রপ্তানির জন্য নতুন বাজার খোঁজা, আইটি শিল্পের জন্য বিকল্প ব্যাবসায়িক মডেল তৈরি করা এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য নীতিগত সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে। আগামী মাসগুলোই বলে দেবে, ভারতীয় রুপি এই চাপ সামলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, নাকি আরো গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে যাবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫