প্রতীকী ছবি
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাবসায়িক পরিমণ্ডলে এক নজিরবিহীন সংকট দেখা দিয়েছে। দেশটির ব্যবসায়ীরা আক্ষরিক অর্থেই যেন ‘পেনি-লেস বা কপর্দকশূন্য’ হয়ে পড়ছেন। এই সংকটের মূলে রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের একটি সিদ্ধান্ত। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পেনি তৈরিকে ‘অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং অপচয়’ বলে অভিহিত করেন। এই ঘোষণার পর মে মাসে ইউএস মিন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে পেনি তৈরি বন্ধ করে দেয়। পেনি তৈরির পেছনে যুক্তিটি ছিল এর উৎপাদন খরচের ওপর ভিত্তি করে। একটি এক সেন্টের পেনি তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় চার সেন্ট। অর্থাৎ সরকার প্রতিটি পেনি তৈরিতে তিন সেন্ট করে লোকসান দিচ্ছিল। এই বিশাল আর্থিক ক্ষতি কমাতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে যে তাৎক্ষণিক সরবরাহ সংকট তৈরি হবে, তা হয়তো পুরোপুরি অনুমান করা যায়নি।
পেনি তৈরি বন্ধ হওয়ার পর থেকে সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছে। ফেডারেল সরকার ব্যাংকগুলোকে পেনি সরবরাহ করতে পারছে না, ফলে ব্যাংকগুলোও ব্যবসায়ীদের পেনি দিতে পারছে না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সেসব দোকানে, যেখানে নগদ টাকায় লেনদেন হয়। ন্যাশনাল রিটেল ফেডারেশনের সিনিয়র ডিরেক্টর ডিলান জিওন বলেন, ‘আগস্টের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের শুরুতে আমরা প্রথম এই সমস্যার কথা শুনতে পাই। যেসব ব্যবসা নগদ টাকায় লেনদেন করে, তাদের সবাই এর দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।’
ক্যাশিয়াররা এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যখন একজন ক্রেতা নগদ টাকায় কিছু কেনেন এবং তাকে ভাংতি হিসেবে কয়েক সেন্ট ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন ক্যাশ রেজিস্টারে পেনি না থাকলে কী করণীয়, তা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এই পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ দোকানদার একটি অস্থায়ী সমাধান বেছে নিয়েছেন। তারা মোট বিলকে নিকটতম পাঁচ সেন্টে নামিয়ে বা উঠিয়ে আনছেন। কিন্তু ক্রেতাদের অসন্তুষ্টি এবং সম্ভাব্য আইনি ঝামেলা এড়াতে, বেশির ভাগ ব্যবসাই বিল ‘রাউন্ড ডাউন’ বা কমিয়ে আনার পথ বেছে নিয়েছে। অর্থাৎ কোনো জিনিসের দাম যদি ৪.৯৯ ডলার হয় এবং ক্রেতা পাঁচ ডলার দেন, তাহলে তাকে এক সেন্ট ফেরত দেওয়ার বদলে পাঁচ সেন্ট ফেরত দেওয়া হচ্ছে অথবা বিলটি ৪.৯৫ ডলার ধরা হচ্ছে।
এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কনভেনিয়েন্স স্টোর বা মুদি দোকানগুলো। সুবিখ্যাত কনভেনিয়েন্স স্টোর চেইন ‘কুইক ট্রিপ’ ঘোষণা করেছে যে, তারা বিল নিকেলের (পাঁচ সেন্ট) গুণিতকে রাউন্ড ডাউন করবে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এই কারণে এ বছর তাদের প্রায় তিন মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত লোকসান হতে পারে।
এই সংকট কেবল আর্থিক নয়, আইনি জটিলতাও তৈরি করছে। যেমন-নিউইয়র্কের মতো কিছু শহরে আইন অনুযায়ী বিক্রেতাকে সঠিক পরিমাণ ভাংতি ফেরত দিতে হয়। আবার কিছু জায়গায় কার্ডে পেমেন্ট ও ক্যাশ পেমেন্টের ক্ষেত্রে পণ্যের দামে ভিন্নতা রাখা নিষিদ্ধ। ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশিকা না থাকায় ব্যবসায়ীরা উভয় সংকটে পড়েছেন। অন্যদিকে এই সংকটের একটি সামাজিক দিকও রয়েছে। ‘আমেরিকানস ফর কমন সেন্টস’-এর নির্বাহী পরিচালক মার্ক ওয়েলারের মতে, পেনি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি দেশের নিম্ন-আয়ের মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ওয়েলার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। পেনি না থাকার কারণে পাঁচ সেন্টের মুদ্রা বা নিকেলের চাহিদা বেড়ে যাবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, একটি পাঁচ সেন্টের নিকেল তৈরি করতে সরকারের খরচ হয় প্রায় ১৪ সেন্ট! ফলে পেনি তৈরি বন্ধ করে সরকার যে অর্থ সাশ্রয়ের কথা ভাবছে, নিকেলের বর্ধিত উৎপাদনের কারণে সেই সাশ্রয় আদতে না-ও হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এর আগেও মুদ্রা তুলে নেওয়া হয়েছে। ১৮০০-এর দশকে হাফ-সেন্ট, তিন-সেন্ট এবং ২০-সেন্টের মুদ্রা বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু পেনির মতো একটি বহুল প্রচলিত মুদ্রা, যা ১৭৯৩ সাল থেকে প্রচলিত, তা বন্ধ হওয়ার প্রভাব অনেক বেশি গভীর। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সংকট মোকাবেলায় ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ট নির্দেশিকা প্রয়োজন। রাউন্ডিংয়ের নিয়ম কী হবে, ব্যবসায়ীরা কীভাবে লেনদেন পরিচালনা করবেন এবং সাধারণ মানুষ তাদের কাছে থাকা পেনিগুলো নিয়ে কী করবে, তা নিয়ে স্পষ্টতা দরকার। ডিলান জিওনের মতে, ‘পেনি সব সময়ই থাকবে, কারণ এটি খুব কম ব্যবহৃত একটি মুদ্রা। মানুষ পকেটে রেখে ভুলে যায়, সোফার ফাঁকে হারিয়ে ফেলে বা বয়ামে জমিয়ে রাখে। এই মুদ্রাগুলো বাজারে আসে না।’ আর এই জমানো মুদ্রাগুলোই হয়তো এখন মার্কিন ব্যবসাগুলোকে সাময়িকভাবে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
