জ্বালানি ঋণের ফাঁদ থেকে দেশ রক্ষা করল ইউনূস সরকার
রিসার্চ উইং, দেশকাল নিউজ ডটকম
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:০২
২০২৫ সালের জুনে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেসসচিব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা দেন “জ্বালানি খাতে আর কোনো বকেয়া নেই।”
বাংলাদেশের অর্থনীতি-মাত্র এক বছর আগেও ছিল টালমাটাল অবস্থায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যাচ্ছিল, বিদেশি সরবরাহকারীরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জ্বালানি পাঠানো নিয়ে করছিল গড়িমসি, আর জ্বালানি খাত ডুবে ছিল বিলিয়ন ডলারের বকেয়া ঋণে। এই সংকট এক দিনে তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর অব্যবস্থাপনা, অযথা ব্যয় আর ঋণনির্ভর নীতির ফল ছিল এই দুর্দশার কারণ, যা ছিলও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়ে ওঠা এক গভীর ফাঁদ।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় হাতে পেয়েছিল এই ভঙ্গুর অর্থনীতি। শুধু পেট্রোবাংলারই বকেয়া ছিল ৭৩৭ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যা এলএনজি আমদানির বিল। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বিদেশি তেল সরবরাহকারীদের কাছে ঋণী ছিল আরো ৫৩৩ মিলিয়ন ডলারের। শেভরন ও কাতার এনার্জির মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মাসের পর মাস, কেউ কেউ বছরের পর বছর ধরে পাওনার অপেক্ষায় ছিল। ফলে তেল ও এলএনজি বহনকারী জাহাজগুলোও সরবরাহ বিলম্ব করতে শুরু করে। দেশের জ্বালানি মজুদে দেখা দেয় ভয়াবহ সংকটের আশঙ্কা। অবস্থা ছিল ভয়াবহ। ঋণ শোধের পথে যাওয়াই তাই প্রথম পদক্ষেপ ছিল।
ধাপে ধাপে ঋণ পরিশোধ
সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ধাপে ধাপে বকেয়া পরিশোধ করতে শুরু করে। যদিও ডলার সংকট তখনো কাটেনি, অর্থনীতি ছিল নড়বড়ে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমিয়ে, সতর্ক অর্থ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকার ধীরে ধীরে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা পরিশোধ শুরু করে। ২০২৫ সালের এপ্রিল নাগাদ দৃশ্যমান আশানুরূপ ফল আসতে শুরু করে।
পেট্রোবাংলা ৭৩৭.৫ মিলিয়ন ডলারের এলএনজি ঋণ পুরোপুরি শোধ করে, নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই। এতে সরবরাহকারীদের মধ্যে আবারও আস্থা ফিরে আসে। অল্প সময়ের মধ্যেই কাতার এনার্জি ও ওমান ট্রেডিং লিমিটেডকে পরিশোধ করা হয় আরো ২৫৪ মিলিয়ন ডলারের পুরোনো বিল।
একই সময়ে শেভরন, যাদের পাওনা আওয়ামী আমল থেকেই আটকে ছিল, তারা পায় পুরো ২৪০ মিলিয়ন ডলার। বিলম্বজনিত সুদ হিসেবে দেওয়া হয় বাড়তি ৩০ মিলিয়ন ডলার। তিন বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মার্কিন এ জ্বালানি কোম্পানি ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশের কাছে আর কোনো বকেয়া নেই।
এ এক অভাবনীয় ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
দশ মাসেরও কম সময়ে পাহাড়সম ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে দেশের অবস্থা পরিণত হয় এক সাফল্যের নজিরে। এ গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্র যেন সংখ্যাগুলোই। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এলএনজি ও গ্যাস আমদানিতে মোট বকেয়া ছিল ৬৬০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে সেই অঙ্ক নেমে আসে প্রায় শূন্যে। বিপিসি, যাদের বিদেশি তেল সরবরাহকারীদের কাছে বকেয়া ছিল ৩৪৬ মিলিয়ন ডলার, তারাও মাত্র দুই মাসের মধ্যেই সব পরিশোধ করে। পেট্রোবাংলা ইতিহাস গড়ে এক মাসেই পরিশোধ করে ৪১৯ মিলিয়ন ডলার, যা তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে সর্বোচ্চ।
২০২৫ সালের জুনে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেসসচিব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা দেন, ‘জ্বালানি খাতে আর কোনো বকেয়া নেই।’ এ ঘোষণাটা শুধু প্রতীকী নয়, অর্থনীতির এক কঠিন অধ্যায়ের সমাপ্তিও।
এই সাফল্যের পেছনের আসল পথটা কি! এই সাফল্য এসেছে শৃঙ্খলার মাধ্যমে, অলৌকিকতায় নয়। সরকার বন্ধ করেছে অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর, স্থগিত করেছে ব্যয়বহুল প্রকল্প, আর কয়েকটি বড় দপ্তরের বাজেট কমানো হয়েছে। সেই সঞ্চিত অর্থ কাজে দিয়েছে সরকারের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে। এই আর্থিক শৃঙ্খলা শুধু বিল মেটায়নি, পাঠিয়েছে এক শক্ত বার্তা-বাংলাদেশ তার দেনা পরিশোধ করে। ফলে আন্তর্জাতিক ঋণপথ আবার খুলতে শুরু করে। এলএনজি সরবরাহ ফের নিয়মিত হয়, তেল সরবরাহকারীরা দেয় আরো ভালো শর্তে চুক্তি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ফিরে আসে আস্থা, যা যেরকোনো অর্থনীতির সবচেয়ে মূল্যবান মুদ্রা।
অর্থনীতির মূল ভিত্তি পুনর্গঠন করা
জ্বালানি খাত হলো আধুনিক অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এটি ভেঙে পড়লে শিল্প, পরিবহন এমনকি খাদ্য সরবরাহও বিপর্যস্ত হয়। আগের সরকারের অব্যবস্থাপনা সেই ধসের দিকেই ঠেলে দিয়েছিল দেশকে। কিন্তু বর্তমান সরকার মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে সেই চিত্র পাল্টে দেয়। দেখিয়ে দেয়, সুশাসনও অর্থের মতোই শক্তিশালী অস্ত্র। রাজনৈতিক সুবিধার চেয়ে জ্বালানি বিল পরিশোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া এক সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল, আর তা হয়েছে প্রমাণিতও।
আজ বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থিতিশীল। জ্বালানি জাহাজ সময়মতো পৌঁছেছে। সরবরাহকারীদের বিশ্বাস ফিরে এসেছে বাংলাদেশের ওপর। বদলে গেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর বয়ান।
এখনো কিছু প্রতিকূলতা বিদ্যমান
অবশ্য এখনো কিছু প্রতিকূলতা বিদ্যমান রয়ে গেছে। জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে, বৈশ্বিক বাজারে চলছে মূল্যের ওঠানামা। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রাণ পেতে শুরু করেছে। বিনিয়োগকারীরা ফিরে পাচ্ছেন আস্থা। আর যে সাধারণ মানুষটা একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিত জ্বালানির জন্য, সে এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত। এই সরকারের নীরব কর্মদক্ষতাই গল্পটা বদলে দিয়েছে। বড় প্রতিশ্রুতি বা স্লোগানে নয়, সরকার ব্যস্ত বাস্তব কাজে-ঋণ পরিশোধে, আস্থা ফেরাতে, দেশকে ফের দাঁড় করাতে। যে দেশ একসময় ডুবে ছিল বকেয়ার জলে, সেই দেশ এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
