Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল চীন, স্বস্তিতে ইউরোপের গাড়ি নির্মাতারা

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৫৫

চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল চীন, স্বস্তিতে ইউরোপের গাড়ি নির্মাতারা

ইউরোপের গাড়ি কারখানাগুলোতে কয়েক সপ্তাহ ধরে যে অশনিসংকেত বাজছিল, তা আপাতত থেমেছে। ভলভো থেকে ফক্সওয়াগন, সবাই যখন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রহর গুনছিল, ঠিক তখনই বেইজিং থেকে এলো স্বস্তির খবর। চীন সেমিকন্ডাক্টর চিপ রপ্তানিতে আরোপিত কঠোর নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে গাড়িশিল্পকে খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে এনেছে। তবে এই স্বস্তির পেছনেও কিন্তু রয়েছে ভবিষ্যতের জন্য এক কঠোর সতর্কবার্তা।

এই সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নেক্সপেরিয়া নামের একটি কোম্পানি। নেদারল্যান্ডসের এই কোম্পানিটির মালিকানা চীনের উইংটেকের হাতে। আধুনিক গাড়ির জন্য অপরিহার্য সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ উৎপাদনে নেক্সপেরিয়া ইউরোপের অন্যতম প্রধান ভরসা। কিন্তু গত অক্টোবরে নেদারল্যান্ডস সরকার ইউরোপের সরবরাহ ব্যবস্থা সুরক্ষিত রাখার যুক্তি দেখিয়ে হঠাৎ করেই কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ডাচ সরকারের ভাষ্য ছিল, ‘গুরুতর প্রশাসনিক ঘাটতির’ কারণে জরুরি পরিস্থিতিতে চিপের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল।

নেদারল্যান্ডসের এই পদক্ষেপকে চীন ভালোভাবে নেয়নি। এর প্রতিক্রিয়ায় বেইজিং অত্যন্ত দ্রুত ও কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নেক্সপেরিয়ার উৎপাদিত চিপ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যেহেতু নেক্সপেরিয়ার ইউরোপে উৎপাদিত চিপের প্রায় ৭০ শতাংশই চূড়ান্ত প্রক্রিয়াকরণের জন্য চীনে পাঠানো হয় এবং সেখান থেকে বিশ্বজুড়ে সরবরাহ করা হয়, তাই চীনের এই সিদ্ধান্তে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়।

ইউরোপিয়ান অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (ইএমইএ) তাৎক্ষণিকভাবে সতর্ক করে জানায়, মজুত থাকা চিপ দিয়ে বড়জোর আর কয়েক সপ্তাহ উৎপাদন চালানো সম্ভব। সংস্থার মহাপরিচালক সিগরিড ডে ভ্রিস বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সরবরাহ সংকট আসন্ন।’ ভলভো, ফক্সওয়াগন এবং জাগুয়ার ল্যান্ড রোভারের মতো শীর্ষস্থানীয় গাড়ি নির্মাতারা কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল।

ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের সঙ্গে নিবিড় আলোচনায় বসে। যার ফলে ১ নভেম্বর ইইউয়ের বাণিজ্য কমিশনার মারোস সেফকোভিচ ঘোষণা দেন, চীন ‘নেক্সপেরিয়া চিপের রপ্তানি প্রক্রিয়া আরো সরলীকরণে’ সম্মত হয়েছে এবং বেসামরিক ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স ছাড়াই রপ্তানির অনুমতি দেবে। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি বাণিজ্যিক বিজয় মনে হলেও এর গভীরে রয়েছে চীনের কৌশলগত বার্তা। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের অধ্যাপক ডেভিড বেইলি বিষয়টিকে মোটরশিল্পের জন্য ‘একটি সতর্কসংকেত’ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘নেদারল্যান্ডস সরকার হয়তো নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পেছনে যৌক্তিক কারণ দেখেছিল, কিন্তু এর পরিণতি কী হতে পারে, তা ভেবে দেখেনি। চীনের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত ও কঠোর।’

অধ্যাপক বেইলির মতে, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় চীনের গুরুত্ব কতটা গভীরে। পশ্চিমের দেশগুলো যখনই নিজেদের স্বার্থে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে, চীন বুঝিয়ে দিচ্ছে যে পাল্টা আঘাত করার ক্ষমতা তাদের হাতেও রয়েছে। তার পরামর্শ, এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপকে বিকল্প সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা ইউরোপের মধ্যেই বিকল্প প্রসেসিং সাইট খুঁজে বের করা জরুরি।’ এর পাশাপাশি ভবিষ্যতে এমন সংকট এড়াতে কোম্পানিগুলোকে পর্যাপ্ত চিপ মজুত রাখার কথাও বলেন তিনি।

তবে চীনের এই পদক্ষেপ শুধু ইউরোপকেন্দ্রিক নয়। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকেও একাধিক ছাড় দিয়েছে বেইজিং, যা দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে চলমান বাণিজ্যিক উত্তেজনা হ্রাসের স্পষ্ট ইঙ্গিত। চীন সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল যেমন-গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম, অ্যান্টিমনি এবং অন্যান্য অতিশক্ত (সুপার হার্ড) উপাদানের ওপর থেকে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছে। মার্কিন পতাকাবাহী জাহাজের বন্দর ফি এক বছরের জন্য বাতিল করা হয়েছে। এমনকি বিরল খনিজ উপাদান ও লিথিয়াম ব্যাটারির মতো কৌশলগত পণ্যের ওপর থেকেও কিছু রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ঘোষণা এসেছে।

এই পদক্ষেপগুলো প্রমাণ করে, চীন বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে আগ্রহী। তবে নেক্সপেরিয়ার ঘটনা দেখিয়ে দিল, সেই স্থিতিশীলতার শর্তগুলো নির্ধারণে বেইজিং নিজের প্রভাব ও ক্ষমতা প্রয়োগ করতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করবে না। ইউরোপের গাড়ি নির্মাতারা আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও এই সংকট তাদের শিখিয়েছে যে, আত্মনির্ভরতা এবং সরবরাহ ব্যবস্থার বহুমুখীকরণ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকা কঠিন হবে। আজকের এই স্বস্তি তাই ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তাকেই সামনে নিয়ে এসেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫