ইউক্রেন যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন খাত
তৌসিফ আহমেদ
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:২৬
প্রতীকী ছবি
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের আগে ক্সেনিয়া কালমুসের জীবন ছিল ফুল, রং আর ইউরোপজুড়ে শৈল্পিক প্রদর্শনীকে ঘিরে। কিয়েভের এই ফুল সজ্জাশিল্পী এখন আর ফুলের তোড়া সাজান না; তার নিপুণ হাতে তৈরি হয় প্রাণঘাতী ফার্স্ট-পার্সন ভিউ (এফপিভি) ড্রোন, যা সম্মুখ সমরে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। ক্সেনিয়ার এই রূপান্তর শুধু একজন ব্যক্তির গল্প নয়, এটি একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। ইউক্রেনের চলমান সংঘাতকে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের ‘প্রথম পূর্ণাঙ্গ ড্রোন যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন এবং এই যুদ্ধই জন্ম দিয়েছে এক বিশাল ও দ্রুত বর্ধনশীল ব্যাবসায়িক খাত। ড্রোন খাত, যা বিশ্বজুড়ে প্রতিরক্ষা শিল্প এবং বিনিয়োগের মানচিত্রকে নতুন করে সাজাচ্ছে।
যুদ্ধের আগে ইউক্রেনে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ড্রোন তৈরি করত, কিন্তু এখন এই সংখ্যা শত শত। কিয়েভের দাবি অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সেনার মৃত্যুর কারণ বুলেট বা কামান নয়, বরং এই ড্রোন। ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির প্রতিরক্ষা কর্মসূচির পরিচালক স্টেসি পেটিজনের মতে, ইউক্রেনে অসংখ্য ছোট ছোট ব্যক্তিগত উদ্যোগ গড়ে উঠেছে, যেখানে মানুষ তাদের অ্যাপার্টমেন্ট বা গ্যারেজে ড্রোন তৈরি করে সেনাবাহিনীকে দান করছে। এই ‘মম-অ্যান্ড-পপ’ মডেলটি প্রথাগত প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি বড় ধাক্কা। যেখানে বড় সংস্থাগুলোর উদ্ভাবন ও উৎপাদনে দীর্ঘ সময় লাগে, সেখানে ইউক্রেনের এই ছোট উদ্যোগগুলো দ্রুত নিজেদের মানিয়ে নিতে এবং কম খরচে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছে।
ইউক্রেনের এই সাফল্য বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারী এবং প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোর নজর কেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাসড্যাকে তালিকাভুক্ত ছোট ড্রোন-নির্মাতা অ্যারোভায়রনমেন্টের শেয়ারের দাম রাশিয়ার আগ্রাসনের পর চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। লকহিড মার্টিন এবং বোয়িং-এর মতো দানবীয় সংস্থাও এই নতুন বাজার ধরতে তৎপর। ইউরোপেও এই খাতের বৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। পর্তুগালের ড্রোন নির্মাতা টেকএভার সম্প্রতি ‘ইউনিকর্ন’ কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে, যার বাজারমূল্য এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। জার্মানির স্টার্ক ডিফেন্সও তাদের কার্যক্রম দ্রুত প্রসারিত করছে এবং সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সুইনডনে একটি নতুন কারখানা খোলার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য সরকার নতুন সামরিক ড্রোনের জন্য ৪.৫ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে, যা এই শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে আরো উজ্জ্বল করেছে। স্টার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাইক আর্মস্ট্রংয়ের কথায়, ‘আমি মনে করি ড্রোনই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। প্রচলিত অস্ত্রের জায়গা থাকলেও ড্রোন একটি বড় উদ্ভাবন, যা সহজে হারিয়ে যাচ্ছে না।’
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এর পাল্টা প্রযুক্তিও তৈরি হয়। ড্রোনের ব্যাপক ব্যবহার জন্ম দিয়েছে একটি নতুন শিল্পের-কাউন্টার-ড্রোন বা ড্রোন-প্রতিরোধী প্রযুক্তি। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিটি ড্রোনের জন্য তার সংকেত জ্যাম করতে বা সেটিকে ভূপাতিত করার জন্য কেউ না কেউ কাজ করছে। এই বাজারের অন্যতম প্রধান খেলোয়াড় অস্ট্রেলিয়ার ড্রোনশিল্ড, যারা ড্রোন শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করার প্রযুক্তি তৈরি করে। ২০২২ সাল থেকে তাদের শেয়ারের দাম ১৫ গুণ বেড়েছে, যা এই খাতের বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে তুলে ধরে। শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রক্ষার জন্যও এই প্রযুক্তির চাহিদা বাড়ছে।
ড্রোন প্রযুক্তির পরবর্তী ধাপটি হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-চালিত। বর্তমানে বেশির ভাগ ড্রোন একজন অপারেটর দ্বারা পরিচালিত হয়, যা তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বদলে যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন অপারেটর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ড্রোনের ঝাঁক এবং অবশেষে সম্পূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত ড্রোন, যারা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করতে পারবে-এমন প্রযুক্তি আমরা দেখতে শুরু করব। এটি শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও বিপ্লব আনবে।
বলা বাহুল্য, ক্সেনিয়া কালমুসের ফুলের দোকান থেকে ড্রোন তৈরির কারখানায় উত্তরণ একটি প্রতীকী ঘটনা। এটি দেখায় কিভাবে একটি ভয়াবহ সংঘাত একটি সম্পূর্ণ নতুন অর্থনৈতিক খাত তৈরি করতে পারে, যা উদ্ভাবন, বিনিয়োগ ও ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ হয়তো একদিন শেষ হবে, কিন্তু এর হাত ধরে যে ড্রোন এবং ড্রোন-প্রতিরোধী শিল্পের জন্ম হয়েছে, তা বিশ্ব অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে এক স্থায়ী পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এই নতুন শিল্পটি এখন শুধু টিকে থাকার লড়াইয়ের অংশ নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
