Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

কার লাভ, কার ক্ষতি

ধনী বৃদ্ধিতে শীর্ষে বাংলাদেশ

Icon

এ আর সুমন

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২০, ০৯:২৪

ধনী বৃদ্ধিতে শীর্ষে বাংলাদেশ

২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সম্পদশালীর (৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী) সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে বলে জানিয়েছে বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স। 

সম্পদশালী বা ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে গত দশকে বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। 

ওয়েলথ এক্স নিজেদের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত এক দশকে বিশ্বের ধনী জনগোষ্ঠীর সম্পদ পর্যালোচনা ও সামনের ১০ বছরের সম্পদ বণ্টন কেমন হবে তার ওপর একটি গবেষণা চালায়। ‘আ ডিকেড অব ওয়েলথ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। 

গত এক দশকে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে ছোট-বড় অর্থনীতির মিশ্রণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেশ রয়েছে এশিয়ায়। প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে ছয়টিই এশিয়ার। 

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গত ১০ বছরে ১৪.৩ শতাংশ হারে ধনী বেড়েছে। বাংলাদেশের পরেই রয়েছে ভিয়েতনাম। উভয় দেশেই তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক প্রসার ঘটেছে। ভিয়েতনামে ৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে গত ১০ বছর ধরে গড়ে ১৩.৯ শতাংশ হারে। চীনে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ, কেনিয়ার ১৩.১ শতাংশ, ফিলিপাইনে ১১.৯ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ১০.৬ শতাংশ, নিউজিল্যান্ডে ৮.৭ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৮.২ শতাংশ, পাকিস্তানে ৭.৫ শতাংশ ও আয়ারল্যান্ডে ৭.১ শতাংশ হারে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘২৫৫ কোটি টাকার ওপর যাদের সম্পদ আছে, যাদের এমন বিনিয়োগ করার সক্ষমতা বা সম্পদ আছে, সেই আল্ট্রা ধনীর সংখ্যাও কিন্তু বাড়ছে। ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি খুবই ইতিবাচক দিক। তবে ধনীদের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি গরিব মানুষের আয় বৃদ্ধি যদি সেই গতিতে না হয়, তাহলে ধনী-গরিবের আয়ের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। এ কারণে আমরা দেখছি- বাংলাদেশে দিন দিন ধনী-গরিবের আয় বৈষম্য বাড়ছে। ধনীদের আয় যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সেই হারে কিন্তু গরিব মানুষের আয় বাড়ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশে তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ দরিদ্র ও প্রায় দুই কোটি মানুষ অতিদরিদ্র। তাই সরকারকে রিডিস্ট্রিবিউশন করতে হবে।’

ওয়েলথ এক্সের গবেষণায় বলা হয়েছে, গত দশকটা ছিল ধনীদের দশক। ২০১০ সাল থেকে বিশ্বে ধনী ব্যক্তি ও তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে হু হু করে। শতাংশের দিক দিয়ে ৫০ শতাংশেরও বেশি। একটি অব্যাহত ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। ২০০৫ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মিলিয়নিয়রের (যার নিট সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে কমপক্ষে ১০ লাখ ডলার রয়েছে) সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে প্রায় আড়াই কোটিতে পৌঁছেছে। 

২০০৫ সালে বিশ্বের মোট ধনীর ১৮.৬ শতাংশ ছিল এশিয়ায়। ২০১৯ সালে এসে তা ২৭ শতাংশে পৌঁছেছে। সামগ্রিকভাবে সম্পদের এই বৃদ্ধির ওপর গবেষণা চালিত হয়েছে মূলত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা, পুঁজিবাজারের মান, বিশ্ববাজার এবং প্রতিটি দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে সম্পদ বিতরণের ওপর। 

ওয়েলথ এক্সের এই গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়ায় ৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা তিন গুণ হয়েছে। এক দশকে ১০ শতাংশ বেড়ে ২৭ শতাংশ হয়েছে। যদিও অঞ্চলভিত্তিক সম্পদশালীর সংখ্যায় উত্তর আমেরিকা এখনো আধিপত্য বজায় রেখেছে, ৩৯ শতাংশ। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে খুবই শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি নিয়ে এগিয়ে চলেছে এই অঞ্চল। অন্যদিকে ইউরোপ, ঐতিহ্যগতভাবে সম্পদশালী এই অঞ্চলের অবস্থানে বেশ স্থিতি পতন লক্ষ্য করা গেছে। 

গবেষণায় সম্পদশালী জনগোষ্ঠীকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছে ওয়েলথ এক্স। (১) ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ ডলার সম্পদের অধিকারী, (২) ৫০ লাখ ডলার থেকে ৩ কোটি ডলার সম্পদের অধিকারী বা ভেরি হাই নেট ওর্থ (ভিএইচএনডব্লিউ), (৩) তিন কোটি ডলারের ওপর সম্পদশালী বা আলট্রা হাই নেট ওর্থ (ইউএইচএনডব্লিউ)। 

ওয়েলথ এক্স বলছে, ২০১৯ সালে এসে ধনী ব্যক্তিরা বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিগত সম্পদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করছে, যা প্রায় ১০৪ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০০৫ সালে যা ৫০ ট্রিলিয়ন ডলার ছিল। কোন অঞ্চলে সম্পদশালী বেশি, সেটিও তুলে ধরা হয়েছে এই গবেষণা প্রতিবেদনে। দেখা গেছে, গত এক দশক ও তারও বেশি সময় ধরে চীনে সম্পদশালীর সংখ্যা বিস্ময়কর রকমের বেড়েছে। ধনীর সংখ্যা বেশি এমন ৩০টি অঞ্চলের মধ্যে ২৬টিই চীনের। বাকি চারটি যুক্তরাষ্ট্রের। 

সুষম কাজ বণ্টনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা গেলেও আয়-ব্যয়ের বৈষম্য কমানো যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। 

বৈষম্য কমানোর উপায় হিসেবে নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘ট্যাক্সের মাধ্যমে হোক, কর্মসংস্থান বাড়িয়ে হোক, বিভিন্ন শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে ধনীদের যে অবদান, তা বাড়িয়ে হোক- যদি গরিব মানুষের আয়ের সংস্থান হয়, কর্মসংস্থান হয়, আয় বাড়ে তাহলেই কেবল ধনী-গরিবের আয় বৈষম্য কমানো সম্ভব। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। আয় বৈষম্য অধিক থাকলে কোনো দেশ ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের দেশ হতে পারে না। আয়কর ব্যবস্থায় সংস্কারের মাধ্যমে আয়-ব্যয়ের বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ধরনের একটা পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে।’

দেশে উল্লেখযোগ্য হারে ধনী বেড়ে তা শীর্ষস্থানে পৌঁছানোর প্রেক্ষাপট, বর্তমান পরিস্থিতি ও এর পরিণতি নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সাথে কথা হয় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদের। 

তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের নামে দেশে যা চলছে, সেটার অবধারিত পরিণতি এটি। এ পরিণতির এক নম্বর ফল হলো- ধনীদের পরিমাণ বৃদ্ধি; দুই. চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভয়ংকর বিপর্যয়; তিন. নদী-নালা, খাল-বিল ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া, চার. ব্যাংকগুলো শেষ হওয়া, ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং সব প্রতিষ্ঠান মোটামুটিভাবে বিপর্যস্ত হওয়া। এগুলোর ফলাফলই হলো দেশে ধনীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। এই কোটিপতিদের বিকাশ হয় দখল করে, লুণ্ঠন করে, সম্পদ পাচার করে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগসাজেশের ভিত্তিতে। তার ফলে তারা খুনের আসামি, অপরাধী হলেও সহজে ছাড় পেয়ে যায়। সসম্মানে সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশের বাইরে চলে যায়। ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতাতে তারা অপরাধমূলক তৎপরতার মধ্যে বিদেশে টাকা পাঠায়। যে কারণে টাকার একটি বড় অংশ অপ্রদর্শিত রয়ে যায় ও বিদেশে পাচার হয়। এ ধনীদের জন্য খেলাপি ঋণ আছে, সরকারি প্রণোদনা আছে, নানারকম ভর্তুকি আছে ও তারা কোনো ধরনের ঝামেলায় পড়লে তাদের সরকারি সমর্থন থাকে। মোট কথা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যদিয়ে তারা ধনী শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছে। ‘উন্নয়ন’ নামে যা বলা হয়, যে ধরনের উন্নয়ন ধারা বাংলাদেশে চলছে- এটার অনিবার্য পরিণতিই এটি।’ 

আগামীতে এর পরিণতি আর কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিণতি এখনি তো দেখতে পাচ্ছি আমরা। কয়েক কোটি মানুষ যে অনাহারে আছে কিংবা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে- এটাই তো পরিণতি। এই ধারা যদি চলতে থাকে, বাংলাদেশে সামনে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এমনি তো দূষিত বাতাসের কারণে শ্বাস নেয়া যায় না, বুড়িগঙ্গা শেষ হয়ে গেল, সুন্দরবন ভয়াবহ বিপদের মুখে- এগুলো তো এই ধনীদের কারণেই। এই ধনীরা তার সুফল পাচ্ছে। বিদ্যুৎ খাত থেকে শুরু করে সড়ক নির্মাণ, যে কোনো সেক্টরে যেটি এক টাকায় করা সম্ভব, সেটি দশ টাকায় করা হচ্ছে। ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে অকার্যকর হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে তারা আরো ধনীতে পরিণত হচ্ছে। আর এর পুরো চাপ সাধারণ মানুষের কাঁধে গিয়ে পড়ছে। নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে- খাদ্য নিরাপত্তা নেই, চিকিৎসা নিরাপত্তা নেই, শিক্ষা নিরাপত্তা- সব ক্ষেত্রে জনগণের ওপরেই বিপর্যয়। এটা একটা অবধারিত ফলাফল।’

এটা থেকে বের হয়ে আসার পথ কি- জানতে চাইলে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বের হয়ে আসার জন্য প্রথমেই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে। যারা এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা যদি সরব না হয় তাহলে তো এই অবস্থা পরিবর্তন সম্ভব না। যারা শিক্ষিত, তাদের তথ্যটা দিতে হবে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বুদ্ধিজীবী আছে, অর্থনীতিবিদ আছে- আসলে সমস্যা তো সেখানেই হচ্ছে। যাদের এই ভূমিকাটা পালন করার কথা, সত্য কথা বলা, সঠিকভাবে বিষয়টার তথ্য দেয়া, জনগণকে সচেতন করা- সেখানেই একটা অবহেলা বা অবচেতন দেখতে পাচ্ছি আমরা। এটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না। ‘জ্বি হুজুর’ কালচার থেকে বের হতে হবে। যারা ‘জ্বি হুজুর’ গোষ্ঠীতে ঢুকে গেছে, তাদের তো পরিবর্তন এখন আর হবে না। এসব তোষামদকারীদের সংখ্যা বেশ বড় ও তারা মূলত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর। তবে তরুণ যারা আসছে, তাদের মধ্য থেকে বুদ্ধিজীবী আসবে, অর্থনীতিবিদ তৈরি হবে, চিন্তার সুষ্ঠু বিকাশ ঘটবে। আশা করছি, তাদের হাত ধরেই পরিবর্তন আসবে। একেবারে যে হচ্ছে না তা কিন্তু না; লেখালেখি হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে। ভয়ভীতি, নানারকম বিপদের মধ্যে থেকেও এই তরুণ প্রজন্ম বের হয়ে আসছে, আসবে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫