বিনা পয়সায় বিনিয়োগকারীদের পাশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

রাবেয়া আশরাফী পিংকি
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২০, ০৮:৫৮

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বিশ্ব। ভয়ংকর এই মহামারিতে বিপর্যস্ত দেশগুলো অর্থনীতি বাঁচাতে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বিশেষ করে বিনিয়োগকারীদের চাঙ্গা রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নেয়া পদক্ষেপ চোখে পড়ার মতো।
তবে এর মধ্যে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) এক কানাকড়ি ব্যয় না করেই বিনিয়োগকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ কি আদৌ সম্ভব!
ফেড এই অসম্ভবকে কীভাবে সম্ভব করল, মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইনসেপ্টের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সেটি উঠে এসেছে।
চলতি বছরের ২৩ মার্চ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল একটি দিন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৪৭ হাজারেরও বেশি মার্কিন নাগরিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায় ওইদিন। আরো কয়েক লাখ লোক পরীক্ষা ছাড়াই যত্রতত্র ঘুরছিলেন। এ সময় মৃতের সংখ্যা মাত্র ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার দিকে মোড় নিচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে থাকায় কাজ হারাতে থাকেন বিপুল পরিমাণ মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে লকডাউন কবে নাগাদ শেষ হবে, তার কোনো সংকেত না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে বিনিয়োগকারীরা। তাদের এই অস্থিরতার প্রভাবে সর্বোচ্চ চাঙ্গা অবস্থা থেকে শেয়ারবাজারের ৩৫ শতাংশ পতন ঘটে। তবে দমবন্ধ এই পরিস্থিতির মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুটি পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বস্তি এনে দেয়।
২৩ মার্চ সকালে ফেডের পক্ষ থেকে দেওয়া এক ঘোষণায় বলা হয়, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের সময়ে জনসাধারণ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সহায়তা করতে নির্ধারিত কার্যক্রমের বাইরে অতিরিক্ত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ফেডের ঘোষিত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক সংকটের সময় গৃহীত পদক্ষেপও রয়েছে। এর মধ্যে একটি কর্মসূচি ছিল একদমই নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি করপোরেট ঋণ ক্রয়। ফেডের ইতিহাসে এটিই ছিল বেসরকারিভাবে প্রথম বন্ড ক্রয়।
বেশ কয়েক বছর ধরেই মার্কিন কোম্পানিগুলোর ঋণের অংক বেড়ে যাচ্ছিল। বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে ক্রমবর্ধমান করপোরেট ঋণকে সমস্যা তৈরির অন্যতম উৎস হিসেবে শনাক্ত করেছেন। এর ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও হারিয়ে যায়। মহামারির মতো এমন আকস্মিক সংকট শুধু কোম্পানিগুলোর দেউলিয়াত্বের হারই বৃদ্ধি করবে না, পাশাপাশি বন্ড ডিফল্টের পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। যা পুরো আর্থিক ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। ফলে করপোরেট বন্ড বাজারকে সহায়তা দেয়া মানে বিনিয়োগকারী ও পুঁজিপতিদের সহায়তা করা। এ বিষয়টি আমলে নিয়েই ফেড করপোরেট বন্ড ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
২৩ মার্চ ফেড এ রকম পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়ার পর ওই দিন বিকেলেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা সূচকটি তরতর করে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। এছাড়া কংগ্রেসের ঘোষিত রেকর্ড ২.২ ট্রিলিয়ন ডলারের পুনরুদ্ধার প্যাকেজ প্রদান কর্মসূচির অগ্রগতিও বিনিয়োগকারীদের মনোভাব চাঙ্গা করে দেয়। এই প্রণোদনার একটি বড় অংশ করপোরেট বন্ড ও অন্যান্য বাজারে ফেডের হস্তক্ষেপমূলক কর্মসূচির পেছনে ব্যয়ের সিদ্ধান্ত হয়।
২৭ মার্চ কংগ্রেসে দ্য করোনাভাইরাস এইড, রিলিফ অ্যান্ড ইকোনমিক সিকিউরিটি (কেয়ারস) বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। করোনাভাইরাসের সময় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক, বিভিন্ন পরিবার, ছোট ব্যবসা ও বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের চাকরি সুরক্ষিত রাখতে দ্রুত এবং সরাসরি অর্থসহায়তা দিতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপটি ‘কেয়ারস অ্যাক্ট’ নামে পরিচিত। এ সংবাদটিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আরো এক পশলা স্বস্তি যোগ করে।
ফেড যখন তার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে, সে সময় বেকার ভাতা পাওয়া ও ব্যাংক থেকে প্রণোদনার চেক ভাঙানো নিয়ে মার্কিনীদের গলদ্ঘর্ম হতে হচ্ছিল। ঠিক এমন একটি সময়ে ফেডের সিদ্ধান্ত প্রতিটি শেয়ারবাজার ও ঋণ বাজারকে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও চাঙ্গা করে তোলে।
২৩ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ প্রায় ছয় হাজার পয়েন্ট যোগ হয়, যা পুঁজিবাজারে সাত ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ সৃষ্টি করে। এটি ছিল ১৯৮৭ সালের পর শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন। এছাড়া ফেডের সিদ্ধান্তের সবচেয়ে বড় শক্তিশালী দিক হচ্ছে- এক পয়সা ব্যয় না করে কর্মসূচি চালিয়ে নেয়া। তবে ভবিষ্যৎ ব্যয় বিষয়ে ঘোষণাটি আর্থিক সংকটের পর থেকে ফেডের ওপর নির্ভরশীল বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া যে মাসে শেয়ারবাজার সর্বোচ্চ উল্লম্ফনের দেখা পায়, সে মাসেই দুই কোটি ৫০ লাখ মার্কিন নাগরিক তাদের কাজ হারায়।
করপোরেট ও মিউনিসিপ্যাল বন্ড ক্রয়, বন্ধকী সম্পদ ক্রয় ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজে ঋণের ব্যবস্থা বড় বড় কোম্পানির জন্য বিশালকার ভর্তুকি হিসেবে কাজে লাগে। মার্চ শেষে দেখা যায় রেকর্ড পরিমাণ ইনভেস্টমেন্ট গ্রেডের করপোরেট ঋণ ইস্যু করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের করপোরেট ঋণের মধ্যে ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ ঋণ। এ মাসে মোট ২৬৮ বিলিয়ন ডলারের ইনভেস্টমেন্ট গ্রেডের ঋণ দেয়া হয়েছে বলে মুডিস অ্যানালিটিকসের এক জরিপে জানা গিয়েছে। এপ্রিলে এই অংক ছাড়িয়ে ২৯৬ বিলিয়ন ডলারের ইনভেস্টমেন্ট গ্রেডের বন্ড লেনদেন হয়। সব মিলিয়ে চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বন্ড ইস্যু করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
এছাড়া বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানি থেকে আরো হাজার কোটি ডলারের জাঙ্ক বন্ড ক্রয়েরও ইঙ্গিত দিয়েছে ফেড।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ পদক্ষেপে সমস্যাগ্রস্ত উড়োজাহাজ নির্মাতা থেকে শুরু করে ডেল্টা, এক্সন মোবিল, টি-মোবাইলের মতো কোম্পানিগুলো উপকৃত হয়েছে।
ইন্টারসেপ্টের তথ্য অনুযায়ী, ফেড বন্ড ক্রয়ের ঘোষণা দেয়ার পর ৪৯ শতাংশ বড় কোম্পানি করপোরেট বন্ড ইস্যু করেছে। এছাড়া অল্প সুদে ঋণ নিয়েও উপকৃত হয়েছে অনেক কোম্পানি।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির আইনবিষয়ক অধ্যাপক এবং আর্থিক বাজার ও নীতিমালা বিশেষজ্ঞ ক্যাথরিন জজ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি নিঃসন্দেহে কোম্পানিগুলোর ঝুঁকি মূল্যায়নের উপায় পরিবর্তিত করবে।’
তবে ফেডের এই সহায়তা সবার জন্য সমান নয়। কারণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কোম্পানিগুলোর আরো সহায়তা প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
২৩ মার্চের আগে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কয়েক সপ্তাহ করপোরেট ঋণ বিক্রির ধুম পড়ে। বিনিয়োগকারীরা এ সময় নিরাপদ ট্রেজারি বন্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ সময় তাদের মধ্যে চড়া সুদ পরিশোধ করতে হবে এমন ঋণ ক্রয়ের প্রতি অনাগ্রহ দেখা যায়। ফায়ার ফ্যাক্স ফিন্যান্সিয়াল হোল্ডিংসের সিইও ভি প্রেম ওয়াতসা বলেন, ‘১০ থেকে ১৫ দিন কোনো ধরনের বন্ড ইস্যু হয়নি। এমনকি ট্রিপল-এ গ্রেডের কোম্পানিগুলোও কোনো বন্ড ইস্যু করেনি।’
ফেডের ঘোষণায় পুরো দৃশ্যপট বদলে যায়। মুডিসের স্ট্যানলি বলেন, ‘আমরা বন্ড বাজারকে নিষ্ক্রিয় হতে দিতে পারি না।’ ফেডের পদক্ষেপ ঘোষণার পর পিমকো, ব্ল্যাকরক, ভ্যানগার্ডসহ বিভিন্ন কোম্পানির বিনিয়োগ গ্রেডের শেয়ারদরও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ফেডের মিউনিসিপ্যাল বন্ড ক্রয়, গাড়ি ঋণ, ক্রেডিট কার্ড ঋণ, আবাসন বাজার সংশ্লিষ্ট ঋণ, বড় ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি ঋণ ও ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল খাতের ওপর ফেডের গ্যারান্টি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে টনিকের মতো কাজ করেছে।
ফেডের সহায়তামূলক কর্মসূচি তো ছিলই, পাশাপাশি কেয়ারস অ্যাক্ট থেকে ৪৫৪ বিলিয়ন ডলার ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের এক্সচেঞ্জ স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে (ইএসএফ) দেয়া হয়। যা ফেডের ‘ক্রেডিট ফ্যাসিলিটিজ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইএসএফকে বড় একটি ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই অর্থের সাহায্যে ফেড তার প্রতিশ্রুত পদক্ষেপগুলো সহজে পালন করতে পেরেছে। এর ফলে দেখা গেছে, ২৩ মার্চের মধ্যে শেয়ার বাজারের আকার দাঁড়ায় জিডিপির ১০৩ শতাংশ বা ২১ ট্রিলিয়ন ডলার। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে যা বেড়ে হয় জিডিপির ১৩৬ শতাংশ বা ২৮.৯ ট্রিলিয়ন ডলার।
২৩ মার্চ ঘোষিত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে বলা হয় ফেড সরাসরি করপোরেট বন্ড ক্রয় করবে। মার্কিন করপোরেটদের জন্য এটি ছিল অভূতপূর্ব পুনরুদ্ধার প্যাকেজ। এই পদক্ষেপ ঘোষণার পর থেকে শেয়ার বাজারের সূচকে ৩০ শতাংশ উল্লম্ফন দেখা গেছে। করপোরেট বন্ড তহবিলগুলোও পুনরুদ্ধারের পথে হেঁটেছে। এর ফলে কোম্পানিগুলোও হাজার হাজার কোটি ডলার ঋণ থেকে রক্ষা পেয়েছে। সরকারের বিশাল অংকের ভর্তুকি কর্মসূচির কারণে বোয়িং ও কার্নিভাল ক্রুজের মতো বড় বড় কোম্পানিকে সরাসরি ঋণ নিতে হয়নি।