
গত এক যুগ ধরেই তলানিতে রয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। এই সময়ে বড় বড় সূচক পতনের সাক্ষী হয়েছে বিনিয়োগকারীরা। অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন, কেউ আবার আত্মহত্যারও পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু পুঁজিবাজারের সূচক পতনরোধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কর্তৃপক্ষকে। অন্যদিকে, মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের কারণে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে দুই মাসের বেশি সময় বন্ধ ছিল দেশের পুঁজিবাজার।
৩১ মে চালুর প্রথম দিন দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৪ হাজার ৬০ পয়েন্ট। কিন্তু এরপর থেকেই উত্থান-পতনের মধ্যেই চলছে পুঁজিবাজার। এর পরদিন সূচক ৩ হাজার ৯৯৯ পয়েন্টে নেমে আসে। গত ৪ জুন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হয়েছে মাত্র ৪২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। গত এক যুগের মধ্যে এটি পুঁজিবাজারে সর্বনিম্ন লেনদেন। অন্যদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) পর্যন্ত সূচক ছিল ৩ হাজার ৯৬৯ পয়েন্ট।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধারাবাহিক পতন রোধে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শেয়ার-ইউনিট দরে বেঁধে দেয়া ফ্লোর প্রাইস (সর্বনিম্ন দর) বিনিয়োগকারীদের মনে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করেছে। তবে ফ্লোর প্রাইসের কারণে দ্রুত পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক দরপতন রোধ করা সম্ভব হলেও লেনদেন আশঙ্কাজনকহারে কমেছে। ফলে পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন বিনিয়োগকারী।
বিক্রেতারা শেয়ার বিক্রি করতে চান কিন্তু ক্রেতা নেই। ফলে ক্রেতা সংকটে গতিহীন হয়ে পড়েছে পুঁজিবাজার। বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে শেয়ারের দাম অনেক কম হলেও ক্রেতা নেই। হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে দাম প্রস্তাব করছেন বিক্রেতারা কিন্তু ওই দামের ক্রেতা না থাকায় শেয়ার হাতবদল হচ্ছে না। ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার কারণে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন হচ্ছে। ফলে লোকসানে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেছেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারকে অবহেলা করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজার সম্পৃক্ত যে প্রস্তাবনাগুলো দেয়া হয়েছে, তাতে পুঁজিবাজারকে ভালো করার অথবা স্থিতিশীল করার কোনো পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা নেই। পুঁজিবাজারকে গতিশীল এবং স্থিতিশীল করার জন্য বিএসইসি, মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন, ডিএসই, সিএসই, বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ, বিএএলসি (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব লিস্টেড কোম্পানি) যতগুলো প্রস্তাব দিয়েছে তার কোনোটাই বিবেচনা করা হয়নি। বরং প্রস্তাবিত বাজেটে এমন কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে যা পুঁজিবাজারে নতুন নতুন কোম্পানি লিস্টিং করাকে নিরুৎসাহিত করবে।’
তিনি বলেন, ‘তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্পোরেট ট্যাক্স না কমিয়ে উল্টো অতালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কর্পোরেট ট্যাক্স ২.৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে যে সব কোম্পানি পুঁজিবাজারের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে নিজেদের শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বা সম্প্রসারণ করতে চাইবে এবং দীর্ঘমেয়াদি লোন পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করতে আগ্রহী হবে তারা বরং এখন উৎসাহিত হবে পুঁজিবাজারে না আসার জন্য।’
ডিএসই পরিচালক বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী ২০২০-২১ বাজেটে অত্যন্ত সহজ শর্তে অপ্রদর্শিত কালো টাকা সাদা করে মূল অর্থনীতিতে নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন করোনাভাইরাসের জন্য দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের সময়ে তা অত্যন্ত যুগান্তকারী ও সঠিক সিদ্ধান্ত। অপ্রদর্শিত টাকা যেখানে যে অবস্থায় আছে সেটা ফিক্সড ডিপোজিট হোক, সঞ্চয়পত্রেই হোক, ব্যাংকে থাকুক, বাড়িতে থাকুক বা কারো সিন্দুকেই থাকুক যেখানেই থাকুক মাত্র ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে টাকাটা সাদা করার সুযোগ দিয়েছেন এবং সেখানে কোনো শর্ত নেই যে এই সাদা টাকাটা তাকে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় বিনিয়োগ করে ধরে রাখতে হবে।’
‘কিন্তু হতাশ হওয়ার কারণ হলো পুঁজিবাজারে শেয়ারে যদি কেউ বিনিয়োগ করে তাকে ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে তিন বছরের জন্য টাকাটা সেখানে ধরে রাখতে হবে। এর অর্থ হলো আমি যদি বুঝে থাকি কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারকে সম্পূর্ণ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। শর্ত নিয়ে কেউ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ১৯৯৭-৯৮, ২০১১-১২ সালে বাজেটে যেখানে একই সুযোগ দেয়া হয়েছিল এবং দুই বছর শেয়ার মার্কেটে রেখে দিতে হবে এই শর্ত দেয়ার ফলে ওই সময় এটা কোনো কাজে আসেনি, কেউ পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগও করেনি’, যোগ করেন ডিএসই পরিচালক।
গত ১৬ জুন ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগসহ একাধিক বিষয় নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদের সাথে বৈঠক করেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সরকারের ঘোষিত বাজেটে পুঁজিবাজারের নানা প্রণোদনার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শর্ত তুলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ডিএসইর একাধিক পরিচালক।