Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

কোরবানির পশুর চাহিদা নিয়ে সংশয়ে খামারিরা

Icon

লোকমান তাজ

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২০, ১৯:৩৬

কোরবানির পশুর চাহিদা নিয়ে সংশয়ে খামারিরা

আসছে পবিত্র ঈদুল আযহা। করোনা সংক্রমণের মাঝে আসন্ন কোরবানির পশু নিয়ে তাই উদ্বেগ বাড়ছে খামারিদের।  দেশে প্রতিবছর কোরবানিতে এক কোটির বেশি গবাদি পশুর চাহিদা থাকে। কিন্তু এবার করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বড় ধরণের ক্ষতির আশংকায় আছেন দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা।

সারাবছর কসাই খানায় গরু বিক্রির সুযোগ থাকলেও ক্ষুদ্র খামারিদের লক্ষ্য থাকে কোরবানির হাটে বেশি লাভে পশু বিক্রি করার। বিশেষ করে যারা কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে একটি বা হাতে গোনা কয়েকটি গরু লালন পালন করছেন, তারা এ বছর উপযুক্ত দামে গরু বিক্রি করতে পারবেন কিনা, সেটা নিয়ে সংশয়ে আছেন।

মানিকগঞ্জ জেলার ফোর্ডনগর গ্রামের বাসিন্দা আফরোজা আক্তার গত সাত মাস ধরে দুটি গরু লালন পালন করে আসছেন। গরু দুটি তিনি কিনেছিলেন ৭০ হাজার টাকায়। প্রতি মাসে এই গরুর পেছনে তার খরচ হয়েছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তিনি ভেবেছিলেন এবারের কোরবানির ঈদে ঢাকার পশুর হাটে ভালো দামে তার গরু দুটি বিক্রি করে লাভ তুলে নেবেন। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে লাভ তো দূরে থাক, এই গরু বিক্রি করে সারা বছরের খরচটাও তুলতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েই সন্দেহে আছেন।

তিনি বলেন, আমার তো ইচ্ছা ছিল অন্তত দেড় লাখ টাকায় গরু দুটো বেচবো। আগের বছরগুলায় এমন দামেই বিক্রি করসি। কিন্তু করোনার কারণে এবারে ওই দাম পাবো না। কিন্তু বিক্রি তো করতেই হবে। আরো এক বছর এই গরু খাওয়া চালানো সম্ভব না।

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ফেসবুক পেজসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কোরবানির পশু বেচাকেনার বিষয়টি নতুন করে সামনে এলেও সেটার সেবা প্রান্তিকে পৌঁছাতে পারছেনা। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে অনেকেই অনলাইনে ছবি পোস্ট করে এমনকি লাইভ ভিডিও দেখিয়ে কোরবানির পশু বেচাকেনা শুরু করেছে।

এরমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পশুর হাট বসবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে জেলা পর্যায়ের কোরবানির হাটও আগের মতো জমে উঠবে না বলে আশংকা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে হাটে না গিয়ে এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে সরকারের বিভিন্ন মহল। 

এ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা দেখা গেলেও অনলাইনে কোরবানির পশু বেচাকেনার বিষয়টি নিয়ে পরিচিত নন প্রান্তিক খামারিরা। আবার ক্রেতারাও অনলাইনে পশু কেনার ব্যাপারে অভ্যস্ত নন। এমন অবস্থায় ওই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যারা কাজ করেন, তারা চেষ্টা করছেন ক্ষুদ্র খামারিদের বোঝাতে যে কিভাবে তারা হাটে না গিয়েই পশু বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব থাকায় তারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও ভরসা করতে পারছেন না।


এমনই এক অনলাইনে গরু বেচাকেনা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী টিটো রহমান বলেন, আমরা যখন মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের বলি হাটে না গিয়ে ঘরে বসেই গরু বিক্রি করতে পারবেন, ওরা হাসাহাসি করে, কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। তাদের কথা হলো, এটা কিভাবে সম্ভব। আবার হাটে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেশিরভাগ মানুষ বের হয়ে না আসায় অনলাইনে পশু বিক্রি করতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষ হাটে গিয়ে দশটা গরু নেড়েচেড়ে একটা গরু কিনতে চায়। অনলাইনে পশুর বিস্তারিত সব তথ্য দেয়া সত্ত্বেও ন্যায্য দাম রাখা সত্ত্বেও কেউ সেভাবে কিনতে আসছে না।

চলমান পরিস্থিতিতে অনেক মানুষের আয় কমে যাওয়ায় কোরবানির পশুর চাহিদাও আগের চাইতে কমে আসবে বলে আশংকা করছেন বিশ্লেষকরা। অনেকে আবার স্বাস্থ্যবিধির কারণে পশু কেনা থেকে বিরত থাকবেন। সব মিলিয়ে ক্ষুদ্র খামারিরা এবার লোকসানের মুখে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী স ম রেজাউল করিম।

কারণ এই মানুষগুলোর জন্য আলাদা প্রণোদনার কোন ব্যবস্থা নেই। তবে বেশিরভাগ খামারি যেন ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেন, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, ক্ষুদ্র খামারিরা যেন তাদের বাড়িতে বসেই অনলাইনে পশু বিক্রি করতে পারে। আমরা সেটাই চেষ্টা করছি। মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার। যেটা কখনোই তাদেরকে ফেরত দিতে হবে না।

করোনাভাইরাসের দুই মাসের বেশি সময় হাট-বাজার বন্ধ থাকায় পশু বেচা-কেনা ছিলো একেবারে কম। তাই এবারের বাজারে গবাদি পশু অন্যান্য বছরের চাইতে বেশি উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু সেই পশুর ন্যায্য মূল্য খামারিরা তুলতে পারবেন কিনা, সেটা বলা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় তরুণদের সাহায্যে প্রান্তিক খামারিদের কাছে অনলাইন সেবাটি ছড়িয়ে দেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষক সায়মা হক বিদিশা।

তিনি বলেন, এবারে অনেক গরু অবিক্রীত থাকবে কিংবা ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে খামারি বঞ্চিত হবে। তাই প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষিত যে তরুণরা আছে, প্রশাসন তাদেরকে কাজে লাগিয়ে এই অনলাইন বেচাকেনা চালু করতে পারে। মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।

ক্ষুদ্র খামারিদের জন্য সরকারের আলাদা কোন প্রণোদনা না থাকায় ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধাগুলো কার্যকরের ওপর কথা বলছেন তিনি। কিছু কিছু ঋণের প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পের আওতায় যদি ক্ষুদ্র খামারিদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া যায়, তাহলে তারা ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে তুলতে পারবেন। এছাড়া করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে কোরবানির পশু পরিবহন, বিপণন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে এ বছর বেশি খরচ হচ্ছে। এই বাড়তি খরচ সরকারকে বহন করার কথাও জানান তিনি।

জানা যায়, এবার দেশের খামারগুলোতে ৬০ লাখ গরু মোটাতাজাকরণে প্রস্তুতি ছিলো। তবে করোনার কারণে এই কাজে ভাটা পড়েছে। কোরবানির গরুর বাজার নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। তাদের অর্ধেক গরু বিক্রি হবে কি না তা নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন খামারিরা। গেলো কোরবানির ঈদে দেশীয় খামারিদের ৪৫ লাখ গরু বিক্রি হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এবার খামারে ৬০ লাখ গরু মোটাতাজাকরণের কাজ চলছিল।


করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সবকিছু বন্ধ থাকায় গো-খাদ্যের দামও চড়া হয়েছে। এক মাস আগে এক বস্তা (৩৭ কেজি) গমের ভুসির দাম ছিলো ১১শ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৪শ টাকা। শুধু গমের ভুসি নয়। সব গো-খাদ্যের দাম গড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। পরিবহন সঙ্কটে গো-খাদ্যের অভাবও দেখা দিয়েছে।

বড় বড় খামারগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে গরু পরিচর্যাকারী শ্রমিকেরও। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো লিমিটেডে কোরবানির জন্য গড়ে প্রস্তুত করা হয় এক হাজার ৫০০ পশু। চড়া দামে গো-খাদ্য কিনে এসব পশুপালন করা হয়। এবার একটু বেশি গরু প্রস্তুত করা হচ্ছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে খামার এবং গৃহস্থ মিলে সাত লাখ পশু আছে। এসব পশু নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। অবশ্য জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, উদ্বেগের কারণ নেই। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এবং আসন্ন কোরবানিতে চট্টগ্রামে পশুর অভাব হবে না। তারা বলেছেন, কোরবানির বাজার সামনে রেখে সাত লাখেরও বেশি পশু প্রস্তুত করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রামে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৩৮টি খামার রয়েছে। এসব খামারে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। প্রতিটি খামারেই রয়েছে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া। খামারগুলোতে বিভিন্ন ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। দুই থেকে দশ কোটি টাকার গরু রয়েছে এমন অনেক খামার রয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রামের গ্রামে-গঞ্জে হাজার হাজার পরিবারে গরু-ছাগল লালন পালন করা হচ্ছে। এনজিও সংস্থাসহ নানা খাত থেকে ঋণ নিয়ে অনেক কৃষক গরু-ছাগল পালন করে কোরবানির সময় বিক্রি করেন। 

নাহার এগ্রো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রকিবুর রহমান টুটুল গণমাধ্যমকে বলেন, চট্টগ্রামে অনেক খামার। প্রতিটি খামারেই অনেক গরু তৈরি করা হয়েছে। নিজের খামারে চার শতাধিক গরু কোরবানির জন্য তৈরি করেছেন। একটি গরুর দাম দুই লাখ টাকা হলেও অন্তত আট কোটি টাকার গরু তিনি প্রস্তুত করেছেন। এভাবে প্রতিটি খামারে কোরবানির জন্য কোটি কোটি টাকার গরু-মহিষ পালন করা হচ্ছে।

অন্যান্য বছর আমেরিকা, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে এমন সময় গরু, উট, দুম্বা ও ছাগল উড়োজাহাজে করে আমদানি করা হত। তবে এবার সেই প্রস্তুতিও বাতিল করা হয়েছে। একইসঙ্গে সাদিক এগ্রোর মতো অন্যান্য খামারেও কোরবানির পশু মোটাতাজাকরণ নিয়ে উভয় সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, চলতি বছরে দেশীয় পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। চলতি সপ্তাহে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু নিয়ে একটা ডাটা প্রস্তুত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে মোট গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখ। সবমিলিয়ে এবারো কোরবানির জন্য ১ কোটি ২০ লাখের ওপরে প্রস্তুত রয়েছে। গত কোরবানির ঈদে ১ কোটি ১৭ লাখ গরু, ছাগল, মহিষ প্রস্তুত ছিলো। এর মধ্যে গরুর সংখ্যা ছিলো ৪৫ লাখ। কোরবানিতে পশু জবাই করা হয়েছিল ১ কোটি ৬ লাখ। ১০ লাখ পশুর যোগান বেশি ছিলো চাহিদা থেকে। সে হিসেবে এবারো বাইরের পশু ছাড়া চাহিদা মেটানো সম্ভব।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দাবি, করোনা ভাইরাসের কারণে কোরবানির পশু ৫ থেকে ১০ শতাংশ কম বিক্রি হবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (খামার) ড. এ বি এম খালেকুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, করোনার ফলে দেশে লকডাউন চলায় গ্রামের প্রান্তিক এলাকা থেকে অনেক খামারে গরু আসতে সমস্যা হচ্ছে। সাপ্লাই চেইনের সংকট চলছে। আমাদের হাতে সম্প্রতি যে ডাটা এসেছে তাতে দেখা গেছে কোরবানির জন্য ৬০ লাখ গরু প্রস্তুত। তবে গত বছরের থেকে এবার কিছুটা কম কোরবানি হবে।

কোরবানি পশুর হাট নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নড়ে চরে বসলেও করোনাভাইরাসের কারণে কোরবানির পশু যদি ৫ থেকে ১০ শতাংশ কম বিক্রি হয় তবে তা খামারিদের জন্য চিন্তার কারণ হয়েই দাঁড়াবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫