
আসছে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় শ্রম অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে প্রতি বছরই। আসন্ন ঈদুল আজহার আগেও এর পুনরাবৃত্তির শংকা রয়েছে। সব গার্মেন্টসে ঠিক সময়ে বেতন-বোনাস হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন শ্রমিক নেতারাও৷
করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) মহামারির প্রেক্ষাপটে চলতি বছর সামগ্রিক শিল্প পরিবেশ অনেকটাই ভিন্ন। গত ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ এড়াতে বন্ধ ছিলো অনেক শিল্প-কারখানা। সংক্রমণ পরিস্থিতির শুরু থেকেই ছাঁটাই, বকেয়া পরিশোধ নিয়ে শিল্প এলাকাগুলোয় কিছু মাত্রায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যায়। বর্তমানে শ্রম অসন্তোষ না থাকলেও ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে অসন্তোষের আশঙ্কা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন শিল্প গোয়েন্দারা।
তারা বলছেন, বেতন-বোনাস নিয়ে সংশয়ের পাশাপাশি গত ঈদের মতো আসন্ন ঈদেও শ্রমিকদের নিজ কর্মক্ষেত্র এলাকা ত্যাগ না করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। এ নিয়েও শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তবে বড় কোন শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেবে না বলে মনে করছেন তারা।
জানা যায়, দেশের শিল্প অধ্যুষিত আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনা-এ ছয় এলাকায় সব খাত মিলিয়ে মোট কারখানা আছে ৭ হাজার ৬০২টি। শিল্প কেন্দ্রীভবনের কারণেই এসব শিল্প এলাকায় একক খাতভিত্তিক কারখানার সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে শুধু পোশাক খাতের কারখানা আছে ২ হাজার ৮৯৩টি। এ খাতেরই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বস্ত্র শিল্পের কারখানা আছে ৩৮৯টি। এছাড়া বেপজার আওতায়ও রয়েছে বেশকিছু বস্ত্র ও পোশাক খাতের কারখানা। এর বাইরে ছয় শিল্প এলাকায় চামড়াজাত পণ্য, আসবাব, সেলফোন সংযোজন, ওষুধ সব খাত মিলিয়ে অন্যান্য কারখানা আছে ৩ হাজার ৮৬৬টি।
ছয় শিল্প এলাকায় যেসব কারখানা ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে বলে আশংকা শিল্প পুলিশের, সে তালিকায় ছোট-বড় সব ধরনের কারখানাই আছে। এক্ষেত্রে শিল্প কেন্দ্রীভবনের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বেতন-বোনাস পরিশোধে সম্ভাব্য ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায়ও। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট ৭ হাজার ৬০২টি কারখানার মধ্যে বেতন-বোনাস পরিশোধে সম্ভাব্য ব্যর্থ কারখানার সংখ্যা ৭৯০। এর মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য কারখানা আছে ৩৮২টি। একই খাতের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য কারখানা ৯২টি। বস্ত্র খাতের শিল্প মালিক সংগঠন বিটিএমএর সদস্য কারখানা ৪০টি। বেপজার আওতাভুক্ত কারখানা ৩২টি। বেতন-বোনাস পরিশোধে সম্ভাব্য ব্যর্থ কারখানার তালিকার বাকি ২৪৪টি অন্যান্য খাতের।
জানা জায়, অনেক কারখানা এখনো জুন মাসের মজুরি পরিশোধ করতে পারেনি। ঈদের আগে তাই বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে সংশয় কাটছে না। কারণ জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মজুরি পরিশোধের জন্য সরকারের কাছে প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সহায়তার আবেদন জানিয়েছিলেন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। আশাবাদী হলেও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে ঈদের আগে বড় কোনো শ্রম অসন্তোষ হবে না বলে মনে করছেন বিকেএমইএর নেতারা। তারা আশা করছেন শ্রমিকরা করোনা মহামারির মধ্যে মালিকদের যে সমস্যা হচ্ছে তা অনুধাবন করতে পারছেন।
শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ছয় শিল্প এলাকায় জুনের বেতন পরিশোধ করেনি, এমন কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ৩৬২। এর মধ্যে বিজিএমইএর অধীন কারখানা আছে ৮৩৫টি, বিকেএমইএর ৬৪৯টি ও বিটিএমএর অধীন ১৬৩টি। জুনের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেনি, বেপজার আওতাভুক্ত এমন কারখানা আছে ৪৫টি। এছাড়া বস্ত্র ও পোশাকের বাইরে অন্যান্য খাতের ১ হাজার ৬৭০টি কারখানায় এখনো জুনের বেতন পরিশোধ করা হয়নি।
শিল্প পুলিশের তথ্যে জানা যায়, বেতন-বোনাস পরিশোধে সম্ভাব্য ব্যর্থ কারখানা সবচেয়ে বেশি গাজীপুর এলাকায়। এ এলাকায় মোট কারখানা আছে ২ হাজার ৭২টি, এর মধ্যে বেতন-বোনাস পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে, এমন কারখানার সংখ্যা ৪৬৬।
গাজীপুরের পরই সবচেয়ে বেশি সম্ভাব্য ব্যর্থ কারখানা রয়েছে চট্টগ্রামে। এ এলাকায় সব খাত মিলিয়ে মোট কারখানা আছে ১ হাজার ২২৯টি। এর মধ্যে বেতন-বোনাস পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে, এমন কারখানার সংখ্যা ১৩৩।
নারায়ণগঞ্জ এলাকায় শিল্প পুলিশের আওতাধীন কারখানা রয়েছে ২ হাজার ৪৫৯টি। এর মধ্যে বেতন-বোনাস পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে ১০০টি। আশুলিয়া এলাকায় মোট ১ হাজার ৩৫৬টি কারখানার মধ্যে ৫৭টি বেতন-বোনাস পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে। ময়মনসিংহ এলাকায় মোট কারখানা আছে ১৩১টি। এর মধ্যে ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে ২০টি কারখানা। খুলনায় ৩৫৫টি কারখানার মধ্যে ১৪টি বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে বলে আশংকা করছে শিল্প পুলিশ।
বেতন-বোনাস বিষয়ে শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি আবদুস সালাম গণমাধ্যমকে বলেন, বিজিএমইএসহ খাতভিত্তিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে আমরা চেষ্টা করছি যেন শ্রমিকরা হাসিমুখে ঈদ করতে পারেন।
ঈদের আগে বস্ত্র ও পোশাক খাতের কারখানাগুলোর শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধে ব্যর্থ কারখানাগুলোকে নিয়ে পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিএমইএর পাবলিক রিলেশন কমিটির চেয়ারম্যান খান মনিরুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ক্রয়াদেশ স্বল্পতা ও অর্থায়ন সংকটে থাকায় বেতন-বোনাস পরিশোধে বেগ পেতে হবে এমন ১৭৭টি কারখানাকে আমরা শনাক্ত করেছি। কারখানাগুলোকে আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি।
বেতন-বোনাস বিষয়ে শ্রমিক নেতারা বলেন, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দুই ঈদে বেসিক বেতনের সমান বোনাস দেয়ার রেওয়াজ থাকলেও সরকার শ্রম আইনে বোনাসের বিষয় উল্লেখ না করে শ্রমিকদের বঞ্চিত করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে৷ উৎসব বোনাস কোনো দয়া নয়, এটা শ্রমিকের অধিকার৷ শ্রমিকদের প্রাপ্য পরিশোধের আহবান জানান তারা৷ তবে করোনাকালে গার্মেন্টসে শ্রমিকরা বেতন পেলেও সব শ্রমিকরা বোনাস পাবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে৷