Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

টিকে থাকার লড়াইয়ে এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২০, ২১:৩২

টিকে থাকার লড়াইয়ে এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি

মহামারি করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর গত মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি স্বাস্থ্যবিধি মেনে আকাশপথে যোগাযোগ শুরু হলেও অনেক দেশই রয়েছে নিষিদ্ধের তালিকায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নাগরিকদের নতুন করে ভিসা দেয়া বন্ধ রাখার পাশাপাশি সরাসরি ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রেখেছে অনেক দেশ। 

মহামারির কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের বিমান কোম্পানিগুলোর জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। তিন মাসের মতো বন্ধ থাকার পর বিমান চলাচল স্বল্প পরিসরে শুরু হলেও যাত্রী পাচ্ছে না এয়ারলাইন্সগুলোর কোনটিই। দেশের তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স কোম্পানির একটির সকল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এ অবস্থায় দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে কিছু সীমাবদ্ধতা ও নিয়মের মধ্যে থেকে নিজেদের নাগরিকদের চলাচল উন্মুক্ত করছে অনেক দেশ। এভিয়েশনের পরিভাষায় যেটির নাম দেয়া হয়েছে ট্রাভেল বাবল। এরই মধ্যে আমেরিকা ও ফ্রান্সের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার থেকে ওই দুই দেশের সঙ্গে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে ভারত। 

ভারতের বেসামরিক বিমানমন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী গণমাধ্যমে বলেন, যতদিন পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা শুরু হচ্ছে না, ততদিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের মধ্যে ফ্লাইট পরিচালনা পরিষেবা চালাতে হবে। তবে সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের যেসব স্বাস্থ্যবিধি রয়েছে, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। জার্মানি ও ব্রিটেনের সঙ্গেও এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা চলছে।

সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের নাগরিকদের ভ্রমণের পথ সৃষ্টি করেছে। এটিকে তারা রেসিপ্রোকাল গ্রিন লেন চ্যানেল বলছে। দুদেশের চুক্তি অনুযায়ী আগামী ১০ আগস্ট থেকে শর্তসাপেক্ষে ‘পারস্পরিক গ্রিন লেন’ দিয়ে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার নাগরিকদের স্বল্পমেয়াদি প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক ও সরকারি ভ্রমণের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করতে দেবে। একই সঙ্গে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসন ভিসা আছে এমন নাগরিকদের কাজের জন্য প্রবেশের অনুমতি দেবে। এসব ভিসাধারীরা তিন মাস পর স্বল্প সময়ের জন্য তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবে ও আবার কাজে প্রবেশ করতে পারে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্রে জানা গেছে, ১৭ জুলাই থেকে ঢাকা-মালয়েশিয়া রুটে ফ্লাইট চালু করেছে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস। ফ্লাইট চালু হলেও আপাতত বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস ট্রানজিট যাত্রী, মালয়েশীয় নাগরিক, দেশটির নাগরিককে বিয়ে করেছেন এমন ব্যক্তি, যারা সেকেন্ড হোম করেছেন, স্টুডেন্টস ও প্রফেশনাল ভিসায় যারা আছেন, শুধু তারাই এ মুহূর্তে ভ্রমণ করতে পারবেন। বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকরা এখনই মালয়েশিয়ায় যেতে ও দেশে ফেরার সুযোগ পাচ্ছেন না। একইভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে চালু হওয়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে বাংলাদেশী যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা বিধিনিষেধ।


করোনা পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশিদের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেও। সম্প্রতি বাংলাদেশে ফ্লাইট চালু করেছে কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস এয়ারলাইনস ও টার্কিশ এয়ারলাইনস। তবে কেবল ট্রানজিট যাত্রীই পরিবহন করছে এয়ারলাইনসগুলো। বাংলাদেশিদের জন্য একই রকম ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি প্রতিবেশি দেশ ভারতেও। এ অবস্থায় বাংলাদেশকেও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও দেশের বাকি তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস বাংলা, নভো এয়ার ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ মার্চ থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত কোন ফ্লাইটই চালাতে পারেনি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন কোম্পানিটির পরিস্থিতি বর্ণনা করছিলেন।

তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে আমাদের ক্যাপাসিটি লস ছিলো ২৬ শতাংশ, যেটা মার্চের শেষে এসে দাঁড়িয়েছিল ৭৬ শতাংশ। মার্চের শেষে সব কমার্শিয়াল অপারেশন বন্ধ হয়ে গেল জুন পর্যন্ত। এরপর থেকে আমরা শুধু চার্টার্ড ও কার্গো ফ্লাইট চালাচ্ছি কিন্তু সেগুলোতো সীমিত। আমরা সম্প্রতি কেবলমাত্র কমার্শিয়াল ফ্লাইট সপ্তাহে একটা ঢাকা-লন্ডন শুরু করেছি। আর শুরু করেছি ইউএইতে শুরু করেছি যেহেতু তারা বিমানবন্দর চালু করেছে। তবে সেখানে অনেক রেষ্ট্রিকশন আছে।

যেখানে বিশ্বের ১৭ টি গন্তব্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করতো বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স, সেখানে এখন মাত্র দুটি গন্তব্যে ফ্লাইট চালু আছে। মোকাব্বির হোসেন বলছেন, এর ফলে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত কোম্পানিটির ১৭শ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। কভিড- ১৯ বিষয়ক স্বাস্থ্য বিধির কারণে এই দুটি গন্তব্যেও উড়োজাহাজের আসন অনুযায়ী যাত্রী নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আইকাও-এর নির্দেশনা হচ্ছে, বিমানের পিছনের দুটি সারি খালি থাকতে হবে। যদি বিমান চলা অবস্থায় কেউ অসুস্থ হয় তাহলে তাকে সেখানে আইসোলেট করা হবে। আবার আমাদের সিভিল এভিয়েশন বলছে পাশাপাশি দুইজন বসতে পারবে না।

তিনি বলেন, তার মধ্যে এখন কভিড-১৯ নেগেটিভ সার্টিফিকেট দিতে হবে যাত্রীদের যা ফ্লাইটের ৭২ ঘণ্টা আগে করাতে হবে। এখন টিকেট আগে বিক্রি হলো কিন্তু তাদের মধ্যে যদি কেউ কভিড পজিটিভ হয় তাহলে তাদের আমি নিতে পারবো না। ফ্লাইট পরিচালনায় এরকম একটা অনিশ্চয়তা রয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে সর্বশেষ তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স চালু ছিলো। বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জুন পর্যন্ত ইউএস বাংলার প্রায় চারশো কোটি টাকার লোকসান হয়েছে, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ২০০ কোটি টাকা এবং নভো এয়ারের লোকসান ৬৯ কোটি টাকা। 

রিজেন্ট এয়ারওয়েজের সকল প্রকার কার্যক্রমই বন্ধ রয়েছে। কোম্পানিটির সকল কর্মীকে তিন মাসের অবৈতনিক ছুটিতে পাঠানো হয়েছিলো যা সম্প্রতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শুধু মহামারি পূর্ববর্তী সময়ে বিক্রি হওয়া টিকেটের অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য অল্প কিছু কর্মী কাজ করছেন।

ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট এসোসিয়েশন আয়াটা সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে যে বাংলাদেশে এয়ারলাইন্স-সহ এভিয়েশন খাতের সাথে নানাভাবে জড়িত ৬৩ হাজার কর্মীর চাকরি ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশে এখনো পর্যন্ত কোন এয়ারলাইন্স কর্মী ছাঁটাই না হলেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান কোম্পানি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের বেতন বিভিন্ন হারে কমিয়ে দিয়েছে।

মার্চের ২৬ তারিখ থেকে বন্ধ থাকার পর জুনের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পুনরায় চালু হলেও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ রয়েছে। যেসব বিমানবন্দর চালু হয়েছে সেখানে স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ির কারণে বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে পয়লা জুন থেকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালু হলেও কোন এয়ারলাইন্সই যাত্রী পাচ্ছে না।


তাই প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। যাত্রীরা খুব বড় ধরনের প্রয়োজন ছাড়া বিমান যাত্রা থেকে বিরত থাকছেন। ঢাকার আয়েশা মজুমদার নিয়মিত আকাশপথে যাতায়াত করতেন। তিনি বলছিলেন কেন তিনি বিমানে ভ্রমণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলছেন, প্রধান কারণ আমরা যেভাবে তথ্য লুকাচ্ছি। কভিড পজিটিভ হলেও বলছি নেগেটিভ। করোনাভাইরাস চীনের উহানে উৎপত্তি হলেও এটা ছড়িয়েছে কিন্তু বিমান যাত্রার কারণে। কে কী বহন করছে আমরা কিন্তু জানি না। বিমান যাত্রাটা হলো খামে ভরে পার্সেল পাঠানোর মতো। একটা বন্ধ যায়গায় বসে ৩০ বা ৪০ জনের সাথে যাচ্ছি। নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত দরজা জানালা সবকিছু বন্ধ অবস্থায়। আমরা সবাই একসাথে বন্দি হয়ে আছি। সবার নিশ্বাস এক যায়গায় পড়ছে। একটা ভয় ধরে গেছে।

আয়াটার আর একটি হিসেব বলছে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় এই বছর বিমান যাত্রীর সংখ্যা গড়ে ৪৯ শতাংশ কম হবে। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বলছে এবছরের শুরু থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে বিমান যাত্রী এসেছে প্রায় আট লাখের মতো কিন্তু এর পর থেকে জুনে বিমান চলাচল পুনরায় চালুর আগ পর্যন্ত মোটে ৩৪ হাজার যাত্রী এসেছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া বিমান যাত্রীদের অর্ধেকই অভিবাসী শ্রমিক। তাদের কাজ ঝুঁকিতে থাকায় একটা বড় অংশের যাত্রীই এখন নেই।

টিকে থাকতে টিকেটে মূল্যহ্রাসসহ নানা পদ্ধতি অবলম্বন করার চেষ্টা করছে কোম্পানিগুলো। কোন ফ্লাইটে টিকিট বিক্রি কম হলে সেদিন যাত্রীদের যেকোনো একটি কোম্পানি বহন করবে, এমন চুক্তি করেছে বিমান বাংলাদেশ ও নভো এয়ার। যাত্রী চলাচল না থাকলেও খরচ ঠিকই রয়েছে এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলোর। ফ্লাইট পরিচালনা ও বিমানবন্দরে পার্কিং সহ নানা ফি ঠিকই দিতে হচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বিমানের ক্ষেত্রে অনেক দেশ বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করেছে। কভিড ১৯ আক্রান্ত রোগীসহ গুয়াংঝো যাওয়ায় সপ্তাহখানেকের জন্য ইউএস বাংলার ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছিল চীনা কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশে কভিড-১৯ টেস্টের ফল নেগেটিভ হলেও বিদেশে যাওয়ার পর সেই ফল পজিটিভ হয়েছে এমন ঘটনা ঘটার পর সম্প্রতি কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে বিমান চলাচলের উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

তবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বিমান বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে সহজ শর্তে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা পেয়েছে। যার সুদের একটি অংশ সরকার দেবে। ইতিমধ্যেই কিছু ঋণ নিয়েছে কোম্পানিটি। বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও সাড়ে চার শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা দেয়া হবে। তবে এই ঋণ এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করত হবে। বিশ্বব্যাপী বিপাকে পড়া বিমান কোম্পানিগুলোকে সংকট থেকে উত্তরণে তাদের সরকার নানা ধরনের বেইল আউট প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫