Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

কৃষি হতে পারে কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস

Icon

লোকমান তাজ

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২০, ১৯:৪৮

কৃষি হতে পারে কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস

মহামারি করোনাকালে চাকরি হারিয়ে বা ঝুঁকি এড়াতে এখন অনেকেই গ্রামে ফিরছেন। পাশাপাশি বিদেশ থেকেও চলে এসেছেন অনেক মানুষ। এইসব মানুষের কর্মসংস্থান করতে না পারলে গ্রামীণ অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে। সামনের দিনে কৃষি ব্যবসা ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পই গ্রামীণ কর্মসংস্থানের মূল উৎসে পরিণত হবে। বিশেষ করে দুগ্ধ, মাংস, শস্য, পোলট্রি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের মাধ্যমেই চাকরি বা উদ্যোক্তা তৈরি হবে।

কভিড-১৯-এর প্রভাবে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও অর্থনৈতিক ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে, যার পরিমাণ হতে পারে ৯ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলার। বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও রিসার্স অ্যান্ড পলিসি ইনটিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট ( র‌্যাপিড) আয়োজিত এক কর্মশালায় এমন তথ্য উপস্থাপন করা হয়। 

এমন অবস্থায় কৃষি হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত, জিডিপিতে যার অবদান ১৮.৭ শতাংশ (বিবিএস, ২০১২-১৩)। এ খাত এখনো শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশে আশংকাজনক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি (বাৎসরিক ১.৩৭ শতাংশ) দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিকূলতা হিসেবে বিবেচিত। এই বিশাল জনসংখ্যার ভরণ পোষণের জন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষির টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে কৃষি জমির হ্রাস (বাৎসরিক ১.০ শতাংশ হারে) এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলবায়ুর প্রভাব খাদ্য উৎপাদনে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।  

ভবিষ্যতে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্দিষ্ট হারে খাদ্য সরবরাহ একান্ত প্রয়োজন। গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষা প্রতিষ্ঠায় কৃষি কী ভূমিকা পালন করছে এবং করতে পারে তা অনুধাবন করা। 

কর্মসংস্থানের মূল উৎস হতে হলে গ্রামকে উন্নত করতে হবে। গ্রাম উন্নয়ন বলতে গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি ও কুটির শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, সংস্কৃতি ও পরিবেশ- সবকিছুরই উন্নয়ন বোঝায়। এর আধুনিকায়ন মানে সব ক্ষেত্রে নয়া প্রযুক্তির প্রসার ও বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রামে শহরের সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়টিও জড়িত। এ ক্ষেত্রে গ্রামবাংলার প্রকৃত রূপ অটুট রাখতে হবে। গ্রামের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা, গাছপালা, বনবীথি, ক্ষেতখামার আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ যথাযথভাবে অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রণয়ন করতে হবে সব উন্নয়ন পরিকল্পনা।

তাতে নাগরিক সুবিধাসংবলিত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় উন্নত বাসস্থানে পরিণত হবে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি। কৃষি ও কৃষিবহির্ভূত গ্রামীণ খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসবে। মানুষের আয় বাড়বে, বৈষম্য কমবে গ্রামীণ ও শহর জীবনে। গ্রামে বসবাস করতে স্বচ্ছন্দবোধ করবে নারী-পুরুষ সবাই। গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের কৃষি এখন বেশ অগ্রসরমান। কিন্তু কালক্রমে কৃষি একটি কম লাভজনক পেশা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। 

অথচ কৃষি শ্রমিকসহ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে মোট উৎপাদন খরচ। এ সমস্যার সমাধানের জন্য একদিকে উপকরণ ভর্তুকি বাড়ানো দরকার, অন্যদিকে কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করা দরকার কৃষকের জন্য। তাছাড়া উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন ব্যবস্থাকে দক্ষ করে গড়ে তোলা দরকার। তদুপরি জলবায়ুর অভিঘাতপ্রবণ সমস্যা সংকুল কৃষির উৎপাদন ও জীব প্রযুক্তির ওপর গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন।

খাদ্যশস্যবহির্ভূত ফসল যেমন- শাকসবজি, ডাল, তেলবীজ, মসলা ও ফলমূলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জোরদার করা দরকার গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচিকে। বর্তমানে আমাদের শস্য বিন্যাসের উন্নয়ন দরকার।আর্থিক সহায়তা ও বাজেট বাড়ানো দরকার কৃষি খাতে। কৃষি ঋণের সুদ হার কমানো দরকার। ঋণের সঙ্গে সংযুক্ত করা দরকার কৃষি বীমা কর্মসূচিকে। সেই সঙ্গে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কৃষিকে রফতানিমুখী করতে সহায়তা দেয়া প্রয়োজন।

শস্যবহির্ভূত কৃষি খাত যেমন- পশুপাখি, মৎস্য ও বন উপখাতে বিনিয়োগের সুযোগ অনেক বেশি। উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনাও বিস্তর। দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদনে আমরা স্বয়ম্ভরতার কাছাকাছি থাকলেও আমিষজাতীয় খাদ্য উৎপাদনে এখনো আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনো অপুষ্টির শিকার।

মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও ফলমূলের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা অপুষ্টিজনিত সমস্যার সমাধান করতে পারি। এ উপখাতে সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারি প্রণোদনা আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়িয়ে দেবে। নতুন কর্মসৃজনে তা সহায়ক হবে। তদুপরি এসবের সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে। ফলে আমিষজাতীয় খাদ্যের ভোগ বৃদ্ধি পাবে। এজন্য বাজারব্যবস্থা ও সংরক্ষণ সুবিধার উন্নয়ন দরকার।

আমাদের কৃষি খামারগুলো ক্রমেই ছোট আকার ধারণ করছে। উন্নত দেশগুলোতে খামারের আকার বড়। তাতে আধুনিক খামার যন্ত্রপাতির ব্যবহার সহজসাধ্য। কিন্তু এর বিপরীতে আমাদের দেশের জোতগুলো ছোট হওয়ায় যন্ত্রপাতির ব্যবহার ততটা সহজ হচ্ছে না। বড় আকারের বিনিয়োগও তেমন সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সমবায়ভিত্তিক কৃষি খামার গড়ে তোলার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে।

গ্রামে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা দরকার। বর্তমানে বিদেশ থেকে যে রেমিটেন্স আসছে তার সিংহভাগই অর্জন করছে গ্রামের মানুষ। কিন্তু এর উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ কম। গ্রামীণ কৃষি উৎপাদনে, ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাতে এ অর্থ বিনিয়োগ করা যায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে।

আবহমান কাল ধরে হস্তচালিত তাঁত, তেলের ঘানি, বাঁশ-বেত ও মাটির কাজ গ্রামের মানুষের সম্পূরক আয়ের ব্যবস্থা করছে। এগুলোকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। আরও পুঁজিনির্ভর এবং শ্রম সৃজনকারী ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনে উদ্যোগ নিতে হবে গ্রামে। তাছাড়া গ্রামে গ্যাস সংযোগ, পরিবহন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ, বাজার ও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করতে পারে। সর্বোপরি গ্রামের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাতে বিনিয়োগ উৎসাহী হবে গ্রামের মানুষ। স্থায়ী বসবাসের আগ্রহী হবে তারা।

গ্রামের মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ গ্রামীণ উন্নয়নের একটি প্রধান শর্ত। বর্তমানে গ্রামে যে বিনিয়োগ হয় তার বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে আসে। প্রাতিষ্ঠানিক উৎসের অবদান এক্ষেত্রে খুবই কম। অধিক সুদের মহাজনি ব্যবসা গ্রামে এখনও বড় ভূমিকা পালন করছে আর্থিক খাতে। এ অবস্থার উন্নতিকল্পে গ্রামপর্যায়ে ব্যাংক শাখার দ্রুত সম্প্রসারণ দরকার। বিশেষ করে কৃষি ব্যাংক ও রাকাবকে পুরোপুরি নিয়োজিত রাখা দরকার কৃষি ও গ্রামীণ খাতে অর্থায়নের জন্য। তাছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ও কমিউনিটি ব্যাংকিংকে উৎসাহিত করা দরকার।

তদুপরি সমবায় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করে গ্রামীণ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করার নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। গ্রামের মানুষ মহাজনের কাছে যায় ঋণের সহজলভ্যতার জন্য। এটি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। মনে রাখতে হবে, কৃষিতে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং গ্রামীণ অকৃষি খাত সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের বিকল্প নেই।

শহরে যোগাযোগ সহজ। গ্রামে তা ধীরগতির। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ গ্রামীণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধনে সক্ষম। ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে গ্রামগুলোকেও ডিজিটাল কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে।

এর জন্য গ্রামের মানুষের কাছে ব্রডব্যান্ড সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে। তাদের জন্য স্মার্টফোন সহজলভ্য করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি মোবাইল ফোন আছে। এর মাত্র ৩০ শতাংশ স্মার্টফোন। বাকিগুলো ডিজিটাল ফর্মেটে নিয়ে আসতে হবে দ্রুত। গ্রামে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ স্থানীয় জনমনে আস্থার সৃষ্টি করবে। তাদের সুন্দর ও সাবলীল জীবন গড়তে সাহায্য করবে।

গ্রামে এখন ভূমিহীনতা বাড়ছে। জনসংখ্যার চাপে জমিগুলো হচ্ছে খণ্ড-বিখণ্ড। নতুন বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট উন্নয়নের ফলে অনেক জমি চলে যাচ্ছে চাষের বাইরে। তাতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ০.৭৪ শতাংশ কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে চিরায়ত কৃষিজমি সংরক্ষণ করা দরকার ফসল উৎপাদনের জন্য। অপরদিকে ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য আবাসস্থল গড়ে তোলা দরকার প্রতিটি গ্রামে। এ অবস্থায় পরিকল্পিত আবাসন কর্মসূচি হাতে নেয়া দরকার গ্রামের ক্রমবর্ধমান বাসিন্দাদের জন্য।

করোনাকালে ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে দ্রুত উন্নতি করতে হলে কৃষি খাতকে শিল্পায়নের সঙ্গে দ্রুত যুক্ত করতে হবে। গ্রামের মানুষের আরো তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছাতে হবে। পণ্য বিপণনের জন্য কৃষক ও খামারিদেরকে অনলাইন বিপণন কৌশলকে কাজে লাগাতে হবে। সামনের দিনে বাংলাদেশে এগ্রিবিজনেসের ওপর যারা পড়াশোনা করবে তারাই চাকরি ও উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে। গ্রামে মানুষ ফিরে যাচ্ছে সেখানে কৃষিভিত্তিক ছোট ব্যবসা এবং বিপণন কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে। বৈশ্বিক ও দেশের বাজারে কৃষি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা মেটাতে দেশের কৃষক ও উদ্যোক্তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। তাহলে কৃষি হতে পারে কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫