নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান
অবৈধ অর্থ সঞ্চয়ের নিরাপদ স্থান

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২০, ২২:৫৪

দেশের নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঘিরে নানা প্রতারণার অভিযোগ নতুন নয়। তবে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব লিজিং কোম্পানি ও সমবায় সোসাইটি পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা দুর্বলতা ও অনিয়ম কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির মানুষ তাদের অবৈধ আয় সঞ্চয়ের নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। টাকা জমা রাখা বা নতুন হিসাব খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকের মতোই কেওয়াইসি ফরম, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও টিআইএন সার্টিফিকেটের ফটোকপি এবং জমাকৃত অর্থ আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানকে অবগত করার বিধান থাকলেও বেশির ভাগ সময় এসব নিয়ম-কানুন মানছে না নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে অবৈধ অর্থ জমা রাখার জন্য এক শ্রেণির গ্রাহক এই সুযোগটিকে বিপুলভাবে কাজে লাগাচ্ছে।
সম্প্রতি এক বৈঠকে দুদক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে আরও স্বচ্ছতার মধ্যে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ চিঠি পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিবের কাছে। দুদকের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, এন্টি-মানিলন্ডারিং ইউনিটের প্রতিবেদনের আলোকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
প্রতারিত হয়েও চুপ
সম্প্রতি কয়েকটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুদক কর্মকর্তারা এমন অনেক ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছেন, যারা নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রেখে প্রতারিত হয়েছেন; কিন্তু সে বিষয়ে কোনো কথা বলছেন না। দুদক কর্মকর্তারা জানান, কিছু সাধারণ মানুষ বেশি মুনাফার লোভে এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রেখে প্রতারিত হয়ে হইচই করলেও দেখা যাচ্ছে, বিশাল অঙ্কের টাকা গচ্চা যাওয়ার পরও অনেকে কোনো কথা বলেন না, এমনকি দুদকের তদন্ত কাজেও সহযোগিতা করেন না। ধারণা করা হয়, এই বিপুল পরিমাণ টাকার বৈধ উৎস দেখাতে সক্ষম হবেন না বলেই তারা এসব বিষয়ে কোনো কথা বলেন না। দুদক মনে করে, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতারক চক্রও থাকে সক্রিয়। গ্রাহকরা ক্ষতির তুলনায় কম প্রতিক্রিয়া দেখাবে এমন সম্ভাবনা থেকে সহজেই টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়ে যান বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
এক পি কে হালদারই মেরেছেন ১০ হাজার কোটি টাকা
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, চারটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার এবং তার সহযোগীদের আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ কমপক্ষে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এই বিপুল টাকা দিয়ে রাজধানীর মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের মতো অন্তত সাতটি স্থাপনা তৈরি করা যেত বলে বিশ্লেষণ করেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের মালিকানাধীন ৩০টি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ওই অর্থ কানাডা, সিঙ্গাপুর ও ভারতে পাচার করা হয়। তারা জানায়, বর্তমানে কানাডায় অবস্থানকারী পি কে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) আড়াই হাজার কোটি টাকা, ফাস ফাইন্যান্স থেকে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা, পিপলস লিজিং থেকে তিন হাজার কোটি টাকা এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
অধিক ঝুঁকিতে ১০ আর্থিক প্রতিষ্ঠান
অনিয়মের মাধ্যমে ঋণের নামে সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ বের করে নিয়ে বেশ কিছু নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। এর ফলে নাজুক অবস্থা দেখা দিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিতে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অন্তত ১০টি। অত্যন্ত নাজুক এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘লাল’ শ্রেণিভুক্ত করে বিশেষ তদারকিতে রেখেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। দুদকের উদ্যোগের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘চিঠি পেলে তা দেখে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা জানার জন্য কয়েকটি সূচকের ওপর বিশেষ পদ্ধতিতে নিরীক্ষা চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, ঋণঝুঁকি, সম্পত্তির (ইকুইটি) মূল্যজনিত ঝুঁকি ও তারল্য অভিঘাত- এ চার ঝুঁকি বিবেচনায় নেওয়া হয়। নিরীক্ষার ভিত্তিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ভালোগুলোকে ‘গ্রিন’ জোন, একটু খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ইয়েলো’ জোন এবং চরম খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘রেড’ জোন শ্রেণিভুক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।