ভারতের নয়া শুল্কনীতি: বাড়াবে বাণিজ্য বৈষম্য

রাবেয়া আশরাফী পিংকি
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২০, ০৯:০২

আমদানিকৃত পণ্যের উৎস সম্পর্কে আরো নিশ্চিত হতে শুল্ক আইনে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে ভারত। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, আমদানি করতে যাওয়া পণ্যের উৎস নিয়ে দেয়া তথ্য সঠিক মনে না হলে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার সুবিধা সাময়িকভাবে স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন দেশটির কর কর্তৃপক্ষ।
এমনকি বিশেষ পরিস্থিতিতে পরবর্তী সময়ে কোনো যাচাই না করেই আমদানির আবেদনটি বাতিল করে দেয়া হবে। ভারতের এ নতুন পদক্ষেপে বাংলাদেশের রফতানি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের নতুন নীতিমালার কারণে বাজারে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শুল্ক সুবিধা পাওয়া যে কারও জন্য কঠিন হবে। শুধু তা-ই নয়, এতে করে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য বৈষম্য আরো বাড়তে পারে।
পণ্যের উৎসের নীতিমালা মূলত রুলস অব অরিজিন (আরওও) নামে পরিচিত। আমদানি করতে যাওয়া পণ্যটি ঠিক কোন উৎস থেকে এসেছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতেই এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, একজন আমদানিকারক অথবা তার এজেন্টকে পণ্য প্রবেশের অনুমতি চেয়ে একটি বিল পূরণ করতে হয়। বিলটিকে ব্যবসায়ীদের এক ধরনের ঘোষণাপত্র হিসেবে দেখা হয়। যেখানে বলা হয় যে, বাণিজ্য চুক্তির আওতায় অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক ছাড় পাওয়ার জন্য উল্লিখিত উৎসের তথ্য সঠিক। এছাড়া কোন কোন পণ্যে শুল্ক ছাড় চাওয়া হয়েছে, সেগুলোও বিলে উল্লেখ থাকে এবং প্রতিটি পণ্যের উৎস সার্টিফিকেটও (সিওও) দেয়া হয়। আমদানিকারককে রেফারেন্স নম্বর, ইস্যু করার সময়, উৎসের ধরন, তৃতীয় কোনো দেশ থেকে সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে কি-না এবং উৎস দেশ থেকে পণ্যটি সরাসরি নিয়ে আসা হয়েছে কি-না, এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে সার্টিফিকেটে উল্লেখ করতে হয়।
অনুযায়ী না হলে কোনোরকম ভেরিফিকেশন ছাড়াই আমদানি আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করা হবে। এছাড়া বিল পূরণের সময় থেকে কমপক্ষে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সব তথ্যাদি আমদানিকারককে তার নিজের কাছে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেকোনো সময় চাওয়ামাত্র এসব তথ্য দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে হস্তগত করতে হবে। তথ্য চাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে তা সরবরাহে ব্যর্থ হলে দায়িত্বরত ভারতীয় কর্মকর্তার কাছে ভেরিফিকেশন সংকেত পাঠানো হবে। আর সরবরাহকৃত তথ্য সঠিক না হলে আমদানি আবেদন কোনো ভেরিফিকেশন ছাড়াই বাতিল করে দিতে পারে কর্তৃপক্ষ।
চলতি বছরের আগস্টে ভারতের শুল্ক বিভাগের নোটিসে এ নীতিমালা সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়া হয়। এই নোটিস দেখার পর বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) ও এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছে মতামত চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ দুটি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, রুলস অব অরিজিনের নতুন নীতিমালা বাণিজ্য চুক্তিগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশেষ করে সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া বা সাফটার প্রতিশ্রুতির সাথে এটি সাংঘর্ষিক। নতুন নীতিমালায় ভারতে বাংলাদেশের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পণ্যের উৎস নিয়ে নতুন নীতিমালার কিছু কিছু ধারা সাফটা আরওও এবং ওসিপির সাথে সাংঘর্ষিক। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে ২০০৬ সালে সাফটা কার্যকর করে সার্কের আট সদস্য দেশ। সাফটার নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ রফতানি পণ্য সার্টিফিকেট অব অরিজিন নথির ভিত্তিতে হতে পারে। পণ্যের জাতীয় উৎস নিশ্চিত করতে দেশগুলোর সরকারি সংস্থা এই সার্টিফিকেট দেয়। বাংলাদেশে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এই সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশগুলো তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মাধ্যমে সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। নতুন করে এ ধরনের উদ্যোগ এবং আবেদন বাতিল করার মানেই হলো আস্থাহীনতা। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য মোস্তফা আবিদ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পুরো বিষয়টিই বিশ্বাসের ওপর পরিচালিত হয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, এখানে বিশ্বাসের অভাব রয়েছে।’
ভারতের প্রণয়ন করা নতুন নীতিমালার আরেকটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সিওওর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে শুল্কমুক্ত রফতানির আবেদন বাতিল করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিটিটিসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাফটা এবং ওসিপিতে একটি প্রভিশন রয়েছে- যেখানে বলা হয়, রফতানিকারকদের আওতার বাইরে রয়েছে এ রকম কিছু ক্ষেত্রে মেয়াদ না থাকলেও সার্টিফিকেট গ্রহণযোগ্য হবে।
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, আরওওর সহায়ক তথ্যাদি পাঁচ বছরের জন্য আমদানিকারকদের রাখতে হবে। এ বিষয়ে বিটিটিসি জানায়, সার্টিফিকেটে প্রয়োজনীয় সব তথ্যই দেওয়া আছে। নতুন করে এ ধরনের নিয়ম-কানুন সাফটার সাথে সাংঘর্ষিক। নতুন নীতিমালা প্রত্যাহারে ভারতকে অনুরোধ করা হবে বলেও বিটিটিসির পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
ইপিবি জানিয়েছে, নতুন নীতিমালার কারণে শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বাতিলের ক্ষমতা থাকবে এবং বিষয়টি রফতানিকারকদের অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেবে। এ অবস্থায় ভারতে রফতানি কমে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। শুধু তা-ই নয়, শুল্ক সুবিধা স্থগিতের ঝুঁকির কারণে আমদানিকারকরাও পণ্য ক্রয়ে নিরুৎসাহিত বোধ করবেন।
উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারতে মোট ১.০৯ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। আর আমদানি করেছে ৫.৭৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ইপিবির মতে, নতুন নীতিমালার কারণে বাণিজ্য ব্যবধান আরো বাড়বে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দ্রুত কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হওয়া উচিত বলে মনে করছে সংস্থাটি।
ভারতের এ পদক্ষেপকে ব্যবসায়ীরা কীভাবে দেখছেন, তা জানতে তাদের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা শিগগিরই আলোচনায় বসবেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক আসিফ ইব্রাহিম বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ডাম্পিংয়ের ঘটনা বৃদ্ধি করতে এ পদক্ষেপগুলো ব্যবহৃত হতে পারে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের পণ্যগুলোই ভারতে সবচেয়ে বেশি শুল্ক সুবিধা পেয়ে আসছে। নতুন নীতিমালা এখন এসব ক্ষেত্রেই বেশি প্রয়োগ হবে। তথ্যাদি জোগাড় করা ও তা সঠিকভাবে উত্থাপন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রফতানিকারকরা বিভিন্ন ধরনের ঝামেলার সম্মুখীন হবেন।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন পরিবর্তন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলে ও তথ্যাদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে শুল্ক অগ্রাধিকার পেতে অনেক বিপত্তির মুখে পড়তে হবে। আমদানিকারক ও রফতানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে কোনো পণ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি) নির্ধারণ করতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন সিপিডির খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অন্যথায় নিয়ম-কানুনের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক সুবিধা বাদ দিয়ে পণ্য আমদানিতে উৎসাহী হয়ে উঠতে পারেন ভারতের ব্যবসায়ীরা। এতে করে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি আরো কমে যেতে পারে।