ভুটানের সাথে পিটিএ
অকৃত্রিম বন্ধুর সাথে সম্পর্কের পরিচর্যা

মাসুদুর রহমান
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৫৯

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বন্দিজীবনে মৃত্যুপুরির অমানিশার অন্ধকার। ওই দুঃসময়ে একটি সংবাদ আনন্দের ঝিলিক নিয়ে এসেছিল।
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের ঘটনা। ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রথম কোনো দেশ আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে মরণপণ সংগ্রামের চরম স্বীকৃতি নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল। একইদিনে তার কয়েক ঘণ্টা পর অবশ্য ভারতও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়; কিন্তু ভুটানের স্বীকৃতিটি প্রথম প্রেমের স্পর্শের মতোই শিহরণ জাগানিয়া।
বাংলাদেশ-ভুটান সম্পর্ক অস্তিত্বের এমনই গভীরে প্রোথিত। হিমালয়কন্যা খ্যাত দেশটির জনসংখ্যা আট লাখের কিছু কম। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বার্ষিকীতে গত ৬ ডিসেম্বর ভুটানের সাথে আরেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটল। বিশ্বের প্রথম কোনো দেশের সাথে বাংলাদেশ অনেকটা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মতো ‘প্রিফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট’ (পিটিএ) সই করেছে। বাংলাদেশ-ভুটান পিটিএ মহামারিকালে অবিস্মরণীয় এক ঘটনা। এই চুক্তি কভিড-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে দুই দেশকে নতুন দিশা দেবে।
বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে সম্পর্ক শুধু ঐতিহাসিকই নয়। বর্তমানে নিবিড়তর বন্ধনে আবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগায়েল ওয়াংচুকের মধ্যে পারিবারিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। রাজার বিয়ের পর রানী গায়ালতসুয়েন জেতসুন পেমা ওয়াংচুককে নিয়ে প্রথম ছয়দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। ওটাই ছিল রাজ দম্পতির হানিমুন। রাষ্ট্রাচারের বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে ভুটানের রাজাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছেলের মতো ভালোবাসেন। তাই বাংলাদেশে হানিমুনকালে গণভবনে এই দম্পতিকে বিয়ে-পরবর্তী মূল্যবান উপহার সামগ্রী দিয়েছিলেন। রাজাও শেখ হাসিনাকে সেই রকম শ্রদ্ধা করেন।
একবার ভুটানে সার্ক সম্মেলন হয়েছিল, প্রটোকল অনুযায়ী রাজপ্রসাদে গিয়ে শেখ হাসিনার রাজার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার কথা। কিন্তু ওই সময়ে রাজা প্রটোকল ভেঙে থিম্পুতে হোটেলে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই ধরনের অনেক ঘটনা দুই পরিবারের মধ্যে আছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ককে নিবিড় করে তোলায় সহায়ক। পাশাপাশি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র।
কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককেও পরিচর্যা করতে হয়। ভুটানের সাথে পিটিএ তেমন পরিচর্যা। এই চুক্তির আওতায় পারস্পরিক সম্মতি ও আলোচনার ভিত্তিতে যে কোনো পণ্য ভুটানে রফতানি করা যাবে। ভুটানের যে কোনো পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করতে পারবে। এক্ষেত্রে, কোনো শুল্ক প্রয়োজন হবে না। এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কয়েকগুণ বাড়বে বলে আশা করা যায়। ভুটানের পাহাড়ি জনপদ নানা ফলমূলে ভরপুর। এসব ফল বাংলাদেশে নিয়মিত আসে। এখন শুল্কমুক্ত সুবিধার ফলে ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে বিশাল বাজার পেয়ে ভুটানের বন্ধুপ্রতীম জনগণ লাভবান হতে পারেন। আবার বাংলাদেশের জুস ভুটানের বাজারে রফতানি আরও বাড়তে পারে। কিংবা ভুটান থেকে ফল এনে বাংলাদেশের কারখানায় হতে পারে জুস।
ভুটান পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ধূমপান নিষিদ্ধ। সুস্থ দেহে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষরা দেশটিতে বাস করেন। সে জন্য সেখানে ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ (জিএনপি) পরিমাপ করা হয়। আর্থিক দিক থেকে ভুটানের জনগণ সামর্থ্যবান বিধায় বাংলাদেশে তৈরি পোশাক বেশি করে ভুটানে রফতানি হতে পারে। বাংলাদেশের অন্যান্য পণ্যও যেতে পারে।
ভুটান একটি স্থলসীমান্ত বেষ্টিত দেশ। তাই বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের জন্য ভুটানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দর ও পানগাঁও নদীবন্দরও অবাধে ব্যবহার করতে পারবে ভুটান। ভুটানের জনসংখ্যা বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চেয়েও কম। ফলে বাংলাদেশের বন্দরগুলো ভুটানকে ব্যবহার করতে দিলে বাংলাদেশের ওপর তেমন কোনো চাপ পড়বে না। বাণিজ্য উন্মুক্ত থাকলেও ভুটানের পণ্যে বাংলাদেশ সয়লাব হয়ে যাবে না। ভারত বেষ্টিত ভুটানে ফল ছাড়া তেমন বেশি রফতানিযোগ্য কোনো পণ্য নেই। তারা ভারতের সাথেই বাণিজ্য করে। তাই ভুটানের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ক্ষতি নেই।
ভুটান কখনো উপনিবেশিক শাসনের অধীনে আসেনি। স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও ১৯৪৯ সালের এক চুক্তির মাধ্যমে দেশটির পররাষ্ট্রনীতি তথা নিরাপত্তার দিক দেখাশোনা করে ভারত। ভুটানে গণতান্ত্রিক উত্তরণে চুক্তিটির সংশোধন করা হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় পররাষ্ট্রনীতির ওপর ভারতের এই প্রভাব বিদ্যমান। ভুটানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝা গেছে ২০১৭ সালে দোকলাম সীমান্তে চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষের মাধ্যমে। তিব্বতঘেঁষা ওই সীমান্তে শিলিগুঁড়ি করিডোর নামের একটি ছোট্ট করিডোর আছে; অনেকে বলেন, ‘চিকেন নেক’ যার নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে থাকা আবশ্যক। কারণ ওই করিডোরের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য যা সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত তার ওপর ভারতের অপর অংশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত। এবার লাদাখ সীমান্তে গ্যালওয়ান উপত্যকায় ফের চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ভূ-রাজনীতির উত্তাপের মধ্যে দোকলাম সীমান্তে চীনের উঁকিঝুঁকি মারার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তার ওপর চীন ও ভুটান উভয় দেশেই বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর বাস। এসব চিন্তা করলে ভুটানও ভারতের কাছে কম স্পর্শকাতর নয়। কেননা চীন দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, বাংলাদেশের সঙ্গে তার প্রভাব বিস্তারের এজেন্ডা ধীরে হলেও বাস্তবায়ন করছে। তার বিপরীতে ভারতের ‘প্রতিবেশি প্রথম’ নীতিও সক্রিয়।
ভারত ও চীনের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ খুব বিব্রত। উভয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা অনিবার্য। ফলে কোনো দেশের সাথে সম্পর্ক তৈরি করলে অন্য দেশে অস্বস্তি দেখা দেয়। অনেকটা ত্রিভুজ প্রেমের মতো- এক বন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠ হলে অন্য বন্ধুর মর্মপীড়া দেখা দেয়, যা সংকট বটে। এতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের দ্বিপক্ষীয় স্থানকে সামনে এগিয়ে নিতে বাঁধার সৃষ্টি হয়। ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও বিস্তৃত করা সম্ভব ভুটানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাংলাদেশে আমদানি করার মাধ্যমে। তবে এক্ষেত্রে ভারতের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করা প্রয়োজন। ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার এমন আলোচনা টেবিলে আছে। ভারত ও চীন উভয় দেশকে বাংলাদেশের প্রয়োজন। তাদের মধ্যে সদ্ভাব থাকা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক।
তবে বৃহৎ ভারত ও চীনের হাঁকডাকের মধ্যে ভুটানের মতো অকৃত্রিম ও গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুর সাথে সম্পর্ক যাতে আড়াল না হয়, সে জন্য ৬ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক স্বীকৃতির দিনে ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের পিটিএ সই তাৎপর্যপূর্ণ। ভুটানের সাথে নিবিড় সম্পর্ককে কাজে লাগাতে হবে। সাংস্কৃতিক বিনিময় জোরদার করাসহ সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে।