Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

ফিরে দেখা ২০২০

রেমিট্যান্সের রেকর্ডের বছরে প্রবাসী কর্মীর ঘোর দুর্দিন

Icon

আনছার আহাম্মদ

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৫৩

রেমিট্যান্সের রেকর্ডের বছরে প্রবাসী কর্মীর ঘোর দুর্দিন

‘চাঁদের দুই পিঠ’ একসঙ্গে দেখছে অভিবাসন খাত। এক পৃষ্ঠে রেকর্ড রেমিট্যান্সের ঝলমলে আলো। আরেক পৃষ্ঠে পাঁচ লাখ প্রবাসী কর্মীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার অন্ধকার।

করোনাভাইরাস মহামারির দুঃসময়েও এ বছর (২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত) পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ প্রায় সাড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি। 

এই সুসংবাদের সাথে দুঃসংবাদ হলো- ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পৌনে চার লাখ কর্মী বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন করোনাকালে চাকরি বা কাজ হারিয়ে। আরো লাখ খানেক নতুন কর্মী ভিসা পেয়েও বিদেশে যেতে পারেননি। কবে যেতে পারবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। লকডাউনে দেশে আটকে কর্মস্থলে ফেরা হয়নি পঞ্চাশ হাজারের মতো কর্মীর।

প্রবাসীদের দুর্দিন চললেও তাদের ঘামে শ্রমে অর্জিত রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে পুষ্ট করছে। ১৫ ডিসেম্বর রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের হাতে এখন আগামী ১১ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর টাকা রয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের মতো ডলার রয়েছে। ২০১৯ সালে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮.২ বিলিয়ন ডলার। করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর রেমিট্যান্স কমবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। জাতিসংঘের প্রাক্কলন ছিল ২৫ শতাংশ রেমিট্যান্স কমবে; কিন্তু সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন কঠোর পরিশ্রমী বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীরা। 

লকডাউন শুরুর পর এপ্রিলে রেমিট্যান্স এসেছিল এক বিলিয়নের কম, ৯৩ কোটি ডলার, যা মার্চের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ কম ছিল। এরপর থেকে বেড়ে চলে রেমিট্যান্স আয়। জুলাইয়ে রেকর্ড ২.৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। সাবেক প্রবাসী কল্যাণ সচিব নমিতা হালদার বলেন, ‘যে সময়ে অর্থনীতি ঝুঁকিতে ছিল, রফতানি আয় তলানিতে নেমেছিল, ঠিক সেই সময়ে প্রবাসীরা দেশে রেকর্ড পরিমাণ টাকা পাঠিয়ে পরিস্থিতি ঠিক রেখেছেন।’

রেমিট্যান্সের এমন সুখবরের বিপরীত চিত্র- কর্মী ফেরত আসার ঢল। জনশক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ফেরত আসা কর্মীরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে আসার কারণেই রেমিট্যান্স বেড়েছে। যার যত সঞ্চয় ছিল, সব নিয়ে দেশে ফেরত আসছেন। তবে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদের দাবি, নগদ ২ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ায় রেমিট্যান্স বেড়েছে। আগামীতে আরো বাড়বে।

মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১ এপ্রিল থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন লাখ ৭৪ হাজার ২৩২ জন কর্মী ফেরত এসেছেন। সবচেয়ে বেশি এক লাখ ১৬ হাজার কর্মী ফেরত এসেছেন সৌদি আরব থেকে। আরব আমিরাত থেকে ফেরত এসেছেন এক লাখ তিন হাজার। সৌদি ফেরতদের সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজ না থাকায় আমিরাত থেকে কর্মীদের ফেরত পাঠাচ্ছে তাদের নিয়োগকারী কোম্পানিগুলো। পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হলে কর্মীদের পুনঃনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছে কোম্পানিগুলো। এই দুই দেশ থেকে ‘আউট পাস’ নিয়ে ফেরত এসেছেন যথাক্রমে ১৯ হাজার ও ৯ হাজার কর্মী। কাগজবিহীন এই ২৮ হাজার কর্মী ভিসা ও আকামার মেয়াদ শেষেও দেশে ফেরেননি। তাদের আঙ্গুলের ছাপ রেখে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তারা কখনো এই দুই দেশে প্রবেশ করতে পারবেন না। 

প্রায় পৌনে চার লাখ কর্মী ফেরত এলেও এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক মনে করছেন না প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ। তিনি বলেন, ‘করোনাকালীন লকডাউন শুরুর পর গত মার্চ ও এপ্রিলে আশঙ্কা ছিল ১০ লাখের মতো কর্মী ফেরত আসবে। সেই তুলনায় কম ফেরত এসেছে। যারা ফেরত আসছে, তাদের পুনর্বাসনে চার শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশেই যেন তারা কিছু একটা করতে পারেন। যারা পুনরায় বিদেশ যেতে চান, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে পাঠানো হবে।’

মন্ত্রী সহজ ঋণের কথা বললেও বাস্তবে তা সহজ নয়। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী কর্মীদের জন্য গত এপ্রিলে ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করে মন্ত্রণালয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো ৫০০ কোটি টাকার প্যাকেজ দেন। গত ১৫ জুলাই থেকে ঋণ বিতরণ শুরু করে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক; কিন্তু গত পাঁচ মাসে মাত্র ৪১১ জন কর্মী মাত্র আট কোটি আট লাখ ঋণ পেয়েছেন। এক লাখ টাকা ২০ হাজার পর্যন্ত বিনা জামানতে ঋণ দিচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হয়। মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের সাব্বির আহমেদ জানান, ব্যাংকে ঘুরে ঋণ পাননি এখন পর্যন্ত। তিনি বলেন, ‘জামানত ছাড়া এক লাখ ২০ হাজার টাকার বেশি ঋণ দেওয়া হয় না। এত অল্প টাকায় খামার বা দোকান কিছুই করা সম্ভব নয়।’

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রাক্কলন অনুযায়ী, ছুটিতে দেশে আসা প্রায় আড়াই লাখ কর্মী লকডাউনে আটকা পড়েছিলেন। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, ‘এদের তো ৮০ শতাংশ ফেরত গেছেন জুনে বিমান চলাচল শুরুর পর।’ এ হিসাবেও অন্তত ৫০ হাজার কর্মী এখনো দেশে আটকা আছেন, যারা কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি। ১২ হাজার কাতার প্রবাসী কর্মী আটকা পড়ে আছেন। কর্মস্থলে ফেরার দাবিতে গত শনিবারও তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। 

তাদের একজন নারায়ণগঞ্জের ইনসুর আলী জানান, গত ২৪ জানুয়ারি তিন মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। ২২ এপ্রিল তার ফেরত যাওয়ার কথা ছিল। বিমানের টিকিটও কাটা ছিল; কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ভালো নয়, এ যুক্তিতে কাতার তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। 

আটকেপড়াদের চেয়েও সংকটে রয়েছেন নতুন কর্মীরা। যারা লকডাউন শুরুর আগে ভিসা পেয়েছিলেন। অনেকের বিমানের টিকিটও কাটা ছিল। এমন সোয়া লাখ কর্মীর মধ্যে ৮৬ হাজার সব প্রক্রিয়া শেষ করে শুধু ওড়ার অপেক্ষায় ছিলেন। তাদের মধ্যে আট হাজার গত দুই মাসে গিয়েছেন। বাকিরা এখনো আটকে আছেন। এর মধ্যে সৌদি আরব ও ওমান করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এই কর্মীরা কবে যেতে পারবেন, তা এখনো নিশ্চিত নয়। অনেক কর্মী যে প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যাওয়ার কথা ছিল, মন্দার কারণে সেই প্রতিষ্ঠানই আর নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান আর কর্মী নিতে রাজি নয়। 

রিক্রুটিং এজেন্সি ফাতেমা এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসের মালিক জাহিদুল ইসলাম জানান, গত মার্চে তার এজেন্সি ৮৫ জন কর্মীর ভিসা, স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ সব প্রক্রিয়া শেষ করলেও লকডাউনের কারণে বিদেশ পাঠাতে পারেনি। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পাঁচজনকে পাঠাতে পেরেছেন। 

রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি যত দ্রুত উন্নতি হবে, তত তাড়াতাড়ি কর্মী পাঠানো যাবে। কর্মী নিয়োগকারী দেশগুলো মনে করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভালো নয়, তাই তারা কর্মী নিচ্ছে না; কিন্তু শ্রীলঙ্কা, নেপাল থেকে নিচ্ছে।’

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে বছরে সাত লাখেরও বেশি কর্মী বিদেশ যাচ্ছেন। ২০১৭ সালে রেকর্ড ১০ লাখ আট হাজার ৫২৫ জন কর্মী গেছেন। গত বছর সাত লাখ ৫৩ হাজার কর্মী কাজ করতে বিদেশে যান। এ বছরও লক্ষ্য ছিল সাত লাখ কর্মী পাঠানোর; কিন্তু গেছেন মাত্র এক লাখ ৮১ হাজার ২১৮ জন। 

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘গড়ে মাসে ৬০ হাজার কর্মী বিদেশ যান। গত ৯ মাসে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা নষ্ট হয়েছে করোনাভাইরাসে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫