স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ
বাণিজ্যে প্রতিকূলতায় পড়বে বাংলাদেশ

এম এইচ রশিদ
প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২১, ০৯:০৩

আর্থিক সক্ষমতার বিচারে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরেকবার স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের নাম সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)।
পর পর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে সুনির্দিষ্ট মান অর্জন করায় আগামী ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পড়বে বাংলাদেশ। এই সময়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের মর্যাদা বাড়বে, ক্রেডিট রেটিং উন্নতি হওয়ায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ হবে। তবে সুবিধার চেয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এখন যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, তা বন্ধ হয়ে যাবে।
জানা যায়, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এই সুপারিশ করেছে সিডিপি। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছি। সমগ্র জাতির জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের।’
এলডিসি কী?
সদস্যদেশগুলোকে উন্নত ও উন্নয়নশীল এই দু’ভাগে বিভক্ত করে জাতিসংঘ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশের অবস্থা অনেক বেশি দুর্বল তাদের এলডিসি বলা হয়। ১৯৭১ সালে সর্বপ্রথম এই তালিকা করা হয়। বর্তমানে এলডিসিভুক্ত দেশ হচ্ছে ৪৬টি। ইতিমধ্যে ভানুয়াতু এই তালিকা থেকে বের হয়েছে। বের হওয়ার জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়ে অপেক্ষমান আছে- অ্যাঙ্গোলা, ভুটান, সাউতুমে ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জ।
দ্বিতীয়বার যোগ্যতা অর্জন করায় এখন ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ। বর্তমান বাংলাদেশ আছে- উগান্ডা, কিরিবাতি, হাইতি, টুভালু, জিবুতি, গিনি, নেপাল, মিয়ানমারের মতো দেশের কাতারে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের কাতারে থাকবে বাংলাদেশ।
উত্তরণের প্রক্রিয়া
এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য তিনটি সুনির্দিষ্ট সূচক ও মাপকাঠি নির্ধারণ করে দিয়েছে জাতিসংঘ। ওই মাপকাঠি তিনটি হচ্ছে- মাথাপিছু জাতীয় আয়, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা ও মানবসম্পদ সূচক। ১৯৭৫ সাল থেকে এলডিসি তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। সর্বপ্রথম ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো এ যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২১ সালের মূল্যায়নেও যোগ্যতা অর্জন করল। চূড়ান্তভাবে তালিকা বের হতে ৩ থেকে ৫ বছর সময় পায় সদস্য দেশগুলো। বাংলাদেশ ২০২৬ সাল উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাবে। এবার বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল ও লাওসের নামও সুপারিশ করেছে সিডিপি। যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও মিয়ানমার ও তিমুর লেসেথো সুপারিশ পায়নি।
এলডিসি থেকে বের হতে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের প্রয়োজন ১ হাজার ২২২ ডলার। ২০২১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৮২৭ ডলার, ২০১৮ সালে যা ছিল ১ হাজার ২৭৪ ডলার। অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে সর্বোচ্চ ৩২ পয়েন্ট থাকতে হয়। বাংলাদেশের এই পয়েন্ট ২৭ এবং ২০১৮ সালে ছিল ২৫। এই পয়েন্ট যত কম হয় দেশটির অবস্থান তত ভালো ধরা হয়। মানবসম্পদ সূচকে সর্বনিম্ন ৬৬ পয়েন্ট থাকতে হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশের এই পয়েন্ট ৭৫ দশমিক ৪ এবং ২০১৮ সালে ৭৩ দশমিক ২ ছিল। কোনো দেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণ করতে হলে কমপক্ষে দুটি যোগ্যতা অর্জন করতে হয় অথবা মাথাপিছু জাতীয় আয় দ্বিগুণ করতে হয়। বাংলাদেশ দুই বারই তিনটি যোগ্যতা অর্জন করেছে। ত্রিবার্ষিকভিত্তিতে এই মূল্যায়ন করে সিডিপি।
উত্তরণে সুবিধা
এলডিসি থেকে উত্তরণ করে উন্নয়নশীল দেশভুক্ত হলে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়বে, ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। পাশাপাশি কিছু সুবিধাও পাবে বাংলাদেশ। এই স্বীকৃতি সারাবিশ্বের পক্ষ থেকে। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বাজারের প্রতিযোগিতা ও আলোচনায় বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। এই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দেশের ক্রেডিট রেটিং বাড়বে। এতে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নেয়া সহজ হবে।
অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে অনেক বেশি ঋণ নেয়ার সুযোগ বাড়বে। এছাড়া রেমিট্যান্স আসার গতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
চ্যালেঞ্জ
এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত, কোটাপ্রথাসহ নানা সুবিধা ভোগ করছে। ২০২৬ সালের পর থেকে এসব কমতে থাকবে বা থাকবে না। এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে রফতানি খাত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় বাংলাদেশ বিভিন্ন শুল্ক বাণিজ্য সুবিধা পায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা চীন ও ভারতে এসব সুবিধা রয়েছে। ২০২৬ সালের পর তা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সুবিধা ২০২৭ সাল পর্যন্ত পাওয়া যাবে। এতে বাংলাদেশের রফতানি আয় ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমে যাবে। বছরে রফতানি কমবে ২৫০ কোটি ডলার বা ২১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
ডব্লিউটিওর তথ্য মতে, এই বাড়তি শুল্কের কারণে রফতানি বছরে ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে।
বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধ শিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধ শিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরো কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে হয় না। এর কারণ, মেধাস্বত্বের (পেটেন্ট) ওপর অর্থ দেওয়া হলে, ওই ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে।
এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেশি বলে ধরে নেয়া হয়, তখন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে।
এলডিসি থেকে বের হলে জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সরকারি কর্মকর্তারা জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় যোগ দিতে সৌজন্য টিকিট পান। ২০২৬ সালের পর এ ধরনের বিনা পয়সার টিকিট মিলবে না। আবার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বৃত্তি দেয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এ ধরনের বৃত্তির সংখ্যা কমে যাবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশের দিনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরকে স্মরণ করার সময়। আবার আমরা গরিব দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশ হতে যাচ্ছি। এই ‘ডুয়েল গ্র্যাজুয়েশনের’ হওয়ার পর যেসব ক্ষেত্রে চাপে থাকবে, তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হবে রফতানির কথা। বিশ্ববাজারে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা আমাদের জন্য শেষ হয়ে যাবে।
উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা থেকে অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার পথ ক্রমান্বয়ে বন্ধ হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থায়ন পাওয়া কঠিন হবে। ওষুধ শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব আইন আরো কড়াকড়ি হবে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা
চুড়ান্তভাবে তালিকা থেকে বের হতে বাংলাদেশ ৫ বছর সময় পাবে। এই সময় বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। মূল্যায়নকারী সংস্থা জাতিসংঘের সিডিপি তিনটি সুপারিশ করেছে বাংলাদেশের জন্য। প্রথমটি হচ্ছে, উত্তরণকালীন স্ট্যাটেজি ঠিক করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ তথা কর আহরণ বাড়াতে হবে।
পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বের হয়ে এসে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
সর্বশেষ বাংলাদেশ সহায়তার জন্য বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সিডিপি। ওষুধ শিল্পের বিদ্যমান সুবিধা বাংলাদেশ যেন আরও কিছু দিন পায় সেটি দেখতে হবে। স্বাস্থ্যখাত ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ যে সহযোগিতা পায়, তা অব্যাহত রাখতে বলছে সিডিপি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণেই বাংলাদেশের রফতানি খাত বিশেষ করে পোশাকশিল্প আজ এই সুদৃঢ় অবস্থানে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর পোশাক খাতই সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাবে ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশকে প্রস্তুত হতে হবে। শ্রম, পরিবেশের উন্নতি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, ব্যবসার সূচকে উন্নতি, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে।