
করোনা সংক্রমণের কারণে বিভিন্ন জেলায় ঋণ আদায় কমে গেছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত দেড় বছর যাবত সরকার ধাপে-ধাপে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করেছে তাতে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ এবং আদায় কার্যক্রম। যেসব এলাকায় করোনার প্রাদুর্ভাব বেশি সেখানে যাতে ক্ষুদ্র ঋণ আদায়ের জন্য এনজিওগুলো চাপ প্রয়োগ না করে সেজন্য মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
এনজিও সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড মহামারির কারণে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসেছে যে ছোট ছোট অনেক এনজিও তাদের কার্যক্রম বন্ধ করার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার একজন মুদি দোকানি রুবেল মোল্লা। প্রায় ছয়মাস আগে দুটো এনজিও থেকে তিনি ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন ব্যবসার জন্য। প্রতি সপ্তাহের তাকে এক হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।
গত মাস খানেক ধরে তিনি কিস্তি দিতে পারছেন না। কারণ করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসন যে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে তাতে ব্যবসা ঠিকমতো চলছে। তবে ঋণ পরিশোধের জন্য এনজিওগুলো তাগাদা দিচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করতি পারতেছি না, ইনকাম নাই। সে হিসাবে এনজিওগুলা যদি কিছু দিন অফ থাকতো। যেভাবে হোক টাকা ম্যানেজ করে দিতে হয়। তবে খুব কষ্ট হয়।
রুবেল মোল্লার মতো হাজার-হাজার ঋণ গ্রহীতা এখন বিপাকে আছেন। সাতক্ষীরার মতো করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত রাজশাহীতেও একই অবস্থা। পরিস্থিতি বিবেচনা স্থানীয় প্রশাসন এনজিও গুলোকে বলেছে যাতে ঋণ আদায়ের জন্য তারা জবরদস্তি না করে।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, ঋণ গ্রহীতাদের যেন একটু সুযোগ দেয়া হয়। তিনি বলেন, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে যদি কোন জোরজবরদস্তির ঘটনা ঘটে তাহলে বিষয়টি যেন জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এনজিও সাথে আলোচনা করে বিষয়টি সুরাহা করা হবে বলে জানান রাজশাহীর জেলা প্রশাসক।
বাংলাদেশের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় এনজিওর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি দফায় লকডাউন বা বিধি-নিষেধ শুরুর পর থেকে তাদের ঋণ আদায়ের হার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ।
যদিও স্বাভাবিক সময়ে এটি ৯৭-৯৯ শতাংশ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী এনজিওর মধ্যে ব্র্যাক অন্যতম।
সংস্থাটির সিনিয়র ডিরেক্টর শামেরান আবেদ বলেন, ঋণের কিস্তি আদায়ের জন্য তাদের দিক থেকে কোন চাপ নেই। তবে ঋণ আদায় কম হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক চাপে পড়েছে।
শামেরান আবেদ জানান, গত বছর লকডাউনের সময় ব্র্যাক-এর ঋণ আদায় কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ ছিলো। গত বছর থেকেই আমরা বলেছি যে যে গ্রাহক আমাদের কিস্তি দিতে চান তাদের কাছ থেকে আমরা নেব। আর যারা বলেছেন যে কিস্তি দেবার সামর্থ্য নেই, আমরা তাদের সময় বাড়িয়ে দিয়ে, আস্তে-আস্তে যোগাযোগ রক্ষা করে কীভাবে টাকা ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। চলতি বছরের শুরুর দিকে ঋণ আদায়ের হার ভালো ছিলো। কিন্তু আবারো লকডাউনের কারণে গত বছরের মতো অবস্থা হয়েছে।
বড় এনজিওগুলোর আর্থিক অবস্থা শক্ত থাকার কারণে সাময়িক সময়ের জন্য তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে। উত্তরাঞ্চল-ভিত্তিক বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও ঠেঙ্গামারা মহিলা সমবায় সমিতির নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বলছেন, ছোট এনজিওগুলো বন্ধ হয়ে যাবার দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকেছে।
হোসনে আরা বলেন, এভাবে কন্টিনিউ করলে টিকে থাকতে পারবে না। আমাদের সাথে অন্তত ৩০টির বেশি ছোট এনজিও আছে যাদেরকে আমরা ক্যাপিটাল দিয়েছি। তারা তো টিকতেই পারছে না। একদম তারা বন্ধ করে দিয়েছে, কোন কাজই করছে না।
সরকারের হিসেবে অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে তিন কোটির বেশি মানুষ ক্ষুদ্র ঋণের গ্রহীতা। হোসনে আরা বলছেন, কোভিড মহামারির কারণে এনজিওগুলো সমস্যার দুষ্টু চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে।
ঋণ গ্রহীতাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না, আবার আদায় করা যাচ্ছে না বলে ঋণ বিতরণও কমে গেছে। ফলে যাদের ঋণের প্রয়োজন তারা ঋণ পাচ্ছে না।